ইলহান ওমর আর রাশিদা তালিব হোক অভিবাসীদের দিশারী


কেউ যেন বলেছিল সারা পৃথিবীর কান্না একদিকে আর স্বজনহারা ভিটেহীন উদ্বাস্তুদের কান্না যদি একদিকে রাখা হয় তবে উদ্বাস্তুদের পাল্লাই ভারি হবে। সভ্যতার সূচনা থেকেই দেখা যায় প্রতিপত্তি আর পার্থিব বাহুল্য খুব কম সংখ্যক মানুষের হাতে থাকে। অন্যদিকে দুবেলা খাবার জুটেনা যাদের তাদের সংখ্যাই সর্বাধিক যা স্থান কাল ভেদে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ হতেও দেখা গেছে। খালি রাজনৈতিক বললে ভুল হবে বরং পুঁজিবাদীর চক্রান্তেই গরীব আর‌ও গরীব হয়, আর ধনীর ভুঁড়ি আকাশ ছুঁয়ে যায়। যখন‌ই পুঁজিবাদের সঙ্গে দালাল শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা বা দল মিশে যায় তখন আসে সমুহ বিপদ। জাতী, গোত্র থেকে শুরু করে এক একটি দেশ ধ্বংস হয়ে যায়। অনাথ বাস্তুহারার সংখ্যা বাড়ে। নিজের জন্মস্থান ছেড়ে বেরিয়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে। এই যাত্রা কখনও মৃত্যুর পর শেষ হয় আর কখনও কিঞ্চিত হলেও কোথাও না কোথাও জ্বলে ওঠে আশার আলো।
উদ্বাস্তু আর অবৈধ অভিবাসীর এই গেইম প্লান নতুন কিছু নয়। চলছে সর্বত্র। আসাম থেকে ঝাড়খণ্ড, আফগানিস্তান থেকে সিরিয়া আর শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে মেক্সিকো পর্যন্ত এক‌ই চক্রান্ত। এই ভারি পাল্লার অশ্রু আর রক্তপাতের পেছনে পুঁজিবাদ আর আগ্রাসন নীতির ককটেল‌ই দায়ী, বিভিন্ন প্রকারে আর বিভিন্ন আকারে। আমার এক প্রাক্তন প্রশিক্ষক যিনি বর্তমানে কানাডায় থাকেন গতকাল‌ই বলছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে আলো আর অন্ধকার দুটোই থাকে। যখন মনে হবে রাত শেষ হচ্ছে না তখন ভুললে চলবে না সে সকাল হতে আর দেরি নেই। আশ্চর্য আজ সকালেই ওনার কথার সত্যতা পেয়ে গেলাম। হৃদয় মন ছুঁয়ে গেল ইলহান ওমর আর রাশিদা তালিবের কথা শুনে।
একসময়ের অস্পৃশ্য কালো সোমালিয়ান অভিবাসী, হিজাব পরা ৩৭ বছরের ইলহান ওমর আজ আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বপ্রথম মুসলমান মহিলা হিসেবে এক সোনালী অধ্যায়ের সুচনা করলেন। মুসলিম মহিলাদের প্রতিনিধি বলে নয় বরং এক উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়ে হয়ে ডেমোক্রেটিক দল থেকে সোজা ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাষ্ট্রীয় নীতির খতরা হতে যাচ্ছে মেয়েটি। উল্লেখ্য আটবছর পর ডেমোক্রেটরা নিম্ন সদন কেড়ে নেওয়ায় রাজনৈতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী এরা যেকোনো সময়ে রিপাবলিকান ট্রাম্পকে বেকাবুতে ফেলতে পারে। ইলহান এই ডেমোক্রেটদের একজন।
আর‌ও দশটা পাঁচটা উদ্বাস্তু পরিবারের শিশুর মতোই শুরু হয় ইলহানের জীবন। মা-বাবার সঙ্গে গৃহযুদ্ধে অস্থির নিজের দেশ ছেড়ে যখন পালাতে হয় তখন ইলহানের বয়স মাত্র আট বছর। এরপর ছোট্ট কালো মেয়েটি কেনিয়ার উদ্বাস্তু শিবিরে চার বছর কাঁটায়। এই সেদিন ১৯৯৭ সালে ইলহানের পরিবার আমেরিকার মিনেসোটা রাজ্যে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। এরপর ইলহানকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। আমেরিকায় থাকার সুবাদে পড়াশোনার পর অভিবাসীর ভিকটিম কার্ড খেলে হয়তো ভালো একটি চাকরি পেয়ে যেতেন তিনি কিন্তু শৈশব আর কৈশোরের সময়ে মানুষের কষ্টের প্রত্যক্ষদর্শী ইলহান রাজনীতিতে যোগ দিলেন। জড়াতে চাইলেন সমাজসেবায়। সময় বদলে গেল শীঘ্রই। দু'বছর আগে রাজ্যের বিধানসভার প্রথম সোমালিয়া বংশোদ্ভূত সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের জন্য কাজ‌ও করেছেন তিনি। সংবাদ সংস্থায় দেয়া সাক্ষাৎকারে ইলহান জানান যে তিনি একজন মুসলমান মহিলা হিসেবে নয় বরং মানুষের নেতা হতে চান। ইলহানের প্রধান এজেন্ডার মধ্যে কয়েকটি হলো সবার জন্য সম্পুর্ন বিনা খরচায় কলেজ শিক্ষা, সবার জন্য ঘর আর ফৌজদারি মামলার সংশোধন।
রাশিদা তালিবের জন্ম হয় ডেট্রয়েট শহরে। অভিবাসী পরিবারের মেয়ে, মা-বাবার চৌদ্দ সন্তানের জৈষ্ঠ্য রাশিদা। ২০১৬ সালে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেট্রয়েট শহরে জোরগতিতে নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন অভিবাসী নীতি নিয়ে ওনাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে রাশিদা। মুসলমানদের প্রতি মূলস্রোতের আমেরিকানদের ঈর্ষা ও ঘৃণাও ক্ষেপিয়ে তুলত রাশিদাকে যা নিয়ে ট্রাম্পকে একহাত নেন। শুরু থেকেই রাজনীতি ও সমাজসেবামূলক কাজকর্মে লিপ্ত রাশিদা ২০০৮ সালে মিশিগান রাজ্য সভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরমধ্যে স্থানীয় এক নেতা যৌন কেলেংকারীতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হ‌ওয়ায় রাশিদার কাছে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিনিধি হ‌ওয়ার সুযোগ আসে। গতকালের নির্বাচনে কার্যত রাশিদার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী‌ই ছিল না। উল্লেখ্য এই আসনে মুলত আফ্রিকান আমেরিকান ভোটার‌ই বেশি। মুসলমান ভোটারদের সংখ্যা নগণ্য। রাশিদা চান সার্বজনীন ও সহজলভ্য স্বাস্থ্য পরিষেবা, পনেরো ডলার (ভারতীয় টাকায় প্রায় এগারোশো টাকা ন্যূনতম দৈনিক মজুরি, ট্যুইশন ফী মুক্ত কলেজ শিক্ষা ইত্যাদি।
এবার মনে করুন ছবিতে দেয়া সিরিয়ার ঐ ছেলে আলিয়ান কুর্দির কথা। মনে হয় লাল টি-শার্ট, নিল হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটির কোনো দুশ্চিন্তা নেই আর। আঁচড়ে রাখা চুল অবিন্যস্ত হয়ে যাবে তাই সমুদ্র তীরে আজ বাতাস বইছে না। যেন কেউ ওকে উঠিয়ে দিক ন‌ইলে রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাবে ওর সোনালী ত্বক। স্বপ্ন দেখার বয়স হ‌ওয়ার আগেই সিরিয়া থেকে পরিবারের সঙ্গে বিদেশে পাড়ি দেয়ার সময় সমুদ্রে ডুবে মৃত্যু হয় তিনবছরের আলিয়ানের। ওর ঘটনা তো জনসমক্ষে এসেছিল কিন্তু এরকম অনেক নিষ্পাপ শিশু আমাদের চোখের আড়ালে হয় জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে ন‌ইলে মাটি চাপা পড়ে আবার মাটির কাছেই ফিরে যাচ্ছে। লাখ লাখ শিশুর মধ্যে ইলহান আর রাশিদারাও জেগে উঠে। ঘন অন্ধকারে এক চিলতে আলো দেখায়। এরকম অসংখ্য ইলহান রাশিদারা একদিন জেগে উঠবে এখানে ওখানে সবখানে, আর বিচার চাইবে অন্যায় অত্যাচারের। সকাল হবে‌ই। প্রকৃতির এটাই নিয়ম।
শরীফ আহমদ | ৭ নভেম্বর ২০১৮

Comments

Popular posts from this blog

দেশ বিদেশের গল্প

বাঙলা অসমীয়া

সাবরমতি টু মথুরা