সাবরমতি টু মথুরা

সাবরমতি টু মথুরা : ১



এটি আহমেদাবাদের সাত সকালের আকাশ। লম্বা উইকেন্ড আসায় বেরিয়ে পড়লাম। লক্ষ্য প্রায় নেই বললেই চলে। আপাততো মথুরা যাচ্ছি। হ্যাঁ, উত্তর প্রদেশ। বাবার এক পুরনো বন্ধু থাকেন। বাবা থাকাকালীন ২০০৬ থেকে ২০১০ অবধি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। ধীরে ধীরে খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছেন। অনেক বার ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করেছেন। যাওয়া হয়নি। কয়েকদিন আগে ফোন হাতড়ে নম্বর পেয়ে গেলাম। আঙ্কেল সেনায় চাকরি করেন। শুনলাম দশেরার আগে‌ বাড়ি আসছেন।‌ আর এই সোমবার কলম্বাস ডে উপলক্ষে অফিস বন্ধ। শনি থেকে সোম তিন দিন ছুটি। ভাবলাম আঙ্কেল আন্টির সঙ্গে দেখা করে আসি। ভাবা মাত্র‌ই কাজ। আহমেদাবাদ থেকে দিল্লি গো এয়ার আর নিজামুদ্দিন স্টেশন থেকে মথুরা জংশনের টিকিট কেটে নিলাম। এখন টেক্সিতে বসে এয়ারপোর্ট যাচ্ছি। সাবরমতি রিভারফ্রন্ট হয়ে উবের ড্রাইভার উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। শীতের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। উজ্জ্বল রোদ ধেয়ে আসছে কিন্তু একটু আধটু কুয়াশা এখন‌ও টিকে থাকতে চাইছে।



সাবরমতী টু মথুরা : ২
 
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে মেট্রোয় চললাম যাতে‌ তাড়াতাড়ি নিজামুদ্দিনে পৌঁছে যেতে পারি। ছিমছাম মেট্রট্রেন ও স্টেশন চত্ত্বর। অন্তত পান গুটখার থুথু নজরে পড়লো না। আমার কাজিন মুকিত আগে থেকেই ট্রেনের এন্ট্রি টোকেন নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আমার সাথে মুকিত‌ও চললো নিজামুদ্দিনে আমাকে উঠিয়ে দিতে। কোনোমতে স‌ওয়া একটা নাগাদ স্টেশনে পৌঁছে সস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ট্রেন মিস হয়নি!
বাইরে খুব গরম। চলছে অক্টোবর কিন্তু মনে হচ্ছিল জুন জুলাইর গরম। ট্রেনে বসে চা খেলাম। আইআরসিটিসির চা ৯৫% মুখে দেয়া যায়না। কিন্তু ভাগ্য ভালো ‌আজকের চা ৫% এর মধ্যেই ছিল। সুস্বাদু।
খুব ঘুম পাচ্ছে। চোখ মেলে রাখতে পারছি না। স্টেশন মিস হয়ে যেতে পারে তাই আগেভাগেই পাশের সিটে বসা আকাশকে বলে রেখেছি। ঘুম পেলে মথুরা আসার আগেই যেন ও আমাকে ডেকে দেয়। আকাশ কোটা যাচ্ছে। ম্যাডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে ও। হরিয়ানার রোহতাকে বাড়ি। এমবিবিএস পাশ করে কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ হতে চায়। হৃদরোগের ডাক্তারের যে অনেক ডিমান্ড আকাশ এখন থেকেই জানে। দেখে মনে হলো খুব মনোযোগী ও পরিশ্রমি ছেলেটি। নিশ্চয়ই কামিয়াব হবে।
প্রথমে হরিয়ানা তারপর উত্তর প্রদেশের অজানা গ্রাম শহরের বুক চিরে ছুটে চলছে ১২০৬০ কোটা জনশতাব্দি এক্সপ্রেস। এই ট্রেনে শোয়ার ব্যবস্থা নেই। চারটে এয়ার কন্ডিশনিং থাকা চেয়ারকার আর পনেরো ষোলোটি জেনারেল। সুপার ফাস্ট গাড়ি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেক্লাইনার সিট। বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এলাম। হ্যান্ড সেনিটাইজার, টিসু সবকিছুই আছে। আমাদের অঞ্চলে ট্রেনে এসব রাখার সঙ্গে সঙ্গে গায়েব হয়ে যাবে! যেখানে বাথরুমের মগ চেইন দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় সেখান টিস্যু পেপার, হ্যান্ড সেনিটাইজারের বোতল টিকে যাবে ত ভাবাও যায় না ‌
জনশতাব্দির এয়ার কন্ডিশন কামরা গুলো মোটামুটি খালিই বলা যায়। দিল্লির নিজামুদ্দিন স্টেশন থেকে মথুরার দুরত্ব ১৩৪ কিলোমিটার। অন্যান্য ট্রেনে বেশি সময় লাগলেও জনশতাব্দি মাত্র দেড় ঘন্টায় পৌঁছে দেয়। ভারতীয় রেলের সবচেয়ে উন্নত খন্ড উত্তর পশ্চিম রেল। আর সবচেয়ে জীর্ণ সম্ভবত আমাদের‌ই উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেল। ভাবতে ভাবতে ঘুম পাচ্ছিল। আরেক কাপ চা নিয়ে বসলাম। মথুরা স্টেশনে বাবার বন্ধু, আমার আঙ্কেল ধর্মপ্রসাদ সিং অপেক্ষা করছেন।


সাবরমতি টু মথুরা : ৩

আগ্রা থেকে প্রায় ৫০ কিমি উত্তরে এবং দিল্লী থেকে ১৪৫ কিমি দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত উত্তরপ্রদেশের এক জেলা মথুরা। প্রশাসনিক কেন্দ্র ও জেলা সদর মথুরা‌ শহর। প্রাচীন কালে এই শহর ছিল এঅঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র। হিন্দুধর্মে মথুরাকে কৃষ্ণের জন্মস্থান হিসেবে মনে করা হয়। বিভিন্ন ধর্মমত অনুযায়ী সাতটি পবিত্র শহরের মধ্যে মথুরা অন্যতম। বেদে মথুরার কথা না থাকলেও রামায়ণ-মহাভারত ও পৌরাণিক যুগের লেখালেখিতে মথুরা উল্লেখিত। মউজপুর, মধুপুরী, মধুবন, মধুরা, মদুরা হয়ে যুগে যুগে নাম বদলে অবশেষে হয়েছে মথুরা। বৌদ্ধদের কাছেও মথুরা একটি বিশিষ্ট স্থান। এখানেই রাজকুমার উপগুপ্ত বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে সম্রাট অশোককে মথুরাতেই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন। ভারত সরকারের ঐতিহ্যবাহী শহর উন্নয়ন যোজনার অন্তর্গত করা হয়েছে এই মথুরাকে।
যথেষ্ট গাছপালা ঘেরা সবুজ এই শহরে এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মন্দির দেবালয়‌‌। উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে এখানে প্রতি বছর কৃষ্ণের জন্মোৎসব পালিত হয়। সারা বছরই তীর্থযাত্রীরা এখানে আসেন। কিন্তু আমি এসেছি অনেক পুরনো এক প্রতিবেশী, আমাদের পরিবারের কাছের মানুষ ধর্মপ্রসাদ সিং আঙ্কেলের সঙ্গে দেখা করতে। মনে হয়না মন্দির বা অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থান দেখার সুযোগ পাবো। মাত্র একদিনের সফর। আঙ্কেলের গ্রামেই থাকবো এক বা দুই রাত।
মথুরা স্টেশনে ঠিক তিনটায় পৌঁছে গেলাম। আমাকে যেতে ‌হবে 'মুরসান' গ্রামে। নিকটবর্তী আরেক জেলা হাতরাসের প্রত্যন্ত অঞ্চল এই মুরসান। স্টেশন থেকে ই-রিক্সায় উঠে পুরনো বাস স্ট্যান্ডে গেলাম যেখান থেকে মুরসানের বাস পাওয়া যাবে বলে আঙ্কেল বলে দিয়েছেন। উনি গাড়ি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। আমিই মানা করেছি। মিছেমিছি কষ্ট দিতে চাই না আর অপরিচিত জায়গায় অপরিচিত হিসেবে ঘুরাফেরা করতে আমার ভালোই লাগে। পুরাতন বাস স্ট্যান্ডে অনেক্ষন দাঁড়ালাম। বাস নেই। একজন বললো এক্ষুনি এসে যাবে। এর মধ্যে একখানা ম্যাজিক গাড়ি এসে দাড়ালো। মুরসান যাবে। ভাড়া তিরিশ টাকা। উঠৈ পড়লাম। পনেরো বিশ মিনিটের মধ্যে মুরসান বাস স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিল।
আঙ্কেল ওনার পুরনো জীপ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। প্রায় দশ বছর পর ওনার সঙ্গে দেখা হলো‌। মুরসান বাজার থেকে ওনাদের বাড়ি পাঁচ ছয় কিলোমিটারের বেশি হবে না। গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলছে গাড়ি। দুইদিকে বাজরার চাষ। এখন বাজরা কাটার সময় চলছে। বাজরা গমের মতোই এক ধরনের শষ্য। এর থেকে আটা তৈরি হয়। বাজরার রুটিই এখানকার প্রধান খাদ্য। ছোট্ট পাকা রাস্তা দিয়ে আঙ্কেলের সঙ্গে যেতে যেতে দেখছিলাম পড়ন্ত বিকেলে লোক মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। কোথাও শুকনো বাজরার গাছ এক করে রাখছেন, কোথাও সাফাই করা বাজরার স্তুপ ট্রেক্টরে লোড করা হচ্ছে আবার কোথাও শুকনো মাঠ আবার তৈরি করা হচ্ছে আলু চাষ করার জন্য। কৃষি নির্ভর এই এলাকা তা দেখতেই বুঝতে পারলাম।
একটি পুরনো কিলা পার হয়েই আঙ্কেলের বিশাল বাড়ি। বিশাল উঠানের এক প্রান্তে দুটি গরু, তিনটে মহিষ বেঁধে রাখা। রিতিমত শেড বানিয়ে রাখা। দুখানা ট্রেক্টর পড়ে আছে। আঙ্কেল চাকরি করেন। ওনার দুই ভাই গ্রামেই থাকেন। সারা বছর কৃষি কর্ম করেন। কৃষি কর্ম মানে আমাদের অঞ্চলের মতো‌ মোটেই নয়। রীতিমত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অন্তত চল্লিশ বিঘা মাটিতে বছরে তিনবার শষ্য ফলান। বাজরা, ধান ও আলু। বাড়ির বাইরে ট্রেক্টরে লাগিয়ে ব্যবহার করার জন্য ছয় সাতটি বড়ো বড়ো যন্ত্র দেখতে পেলাম। সবটির আলাদা আলাদা কাজ। ধান কাটার ও রোপনের, হাল চাষের, আলু রোপনের, বাজরা বা‌ ধান সাফাই করার ছাড়াও বিভিন্ন কাজের মেশিন। ক্ষেতের সব কাজ এখানে মেশিনের সাহায্যেই হয়। কৃষি পদ্ধতির এতো উন্নতি আমাদের অঞ্চলে হতে হতে আরও এক যুগ কেটে যাবে।


সাবরমতি টু মথুরা : ৪

খুব পরিশ্রান্ত ছিলাম। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। আঙ্কেল পন্ডিত বংশের। ওরা খুব একটা মাছ মাংস খাননা তবুও আমি আসায় মাংস রান্না করলেন। সঙ্গে রুটি। নটার আগেই আমি গভীর ঘুমে। খুব ‌ভোরেই ঘুম ভেংগে গেল। এখানে ভালোই ঠান্ডা পড়েছে। প্রাতঃরাশ করে আঙ্কেলের বুলেট নিয়ে গ্রাম দেখতে বেরিয়ে গেলাম। চারপাশে বাজরার খেত। আমার উদ্দেশ্য গতকাল আসার সময় দেখতে পাওয়া কিলায় যাওয়া। জ্যাকেট নিয়ে আসলে ভালো হতো।
ছবিতে থাকা পরিত্যক্ত কিলা রাজা মহেন্দ্র প্রতাপে সিংয়ের আদি বাড়ি। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে রাজা মহেন্দ্রের ছবি রয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজ সংস্কারক রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ সিংহের (১৮৮৬-১৯৭৯) জন্মস্থান অধুনা উত্তর প্রদেশের এই মুরসান গ্রামে। ইনি ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের এক অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থক। পড়াশোনা করেছিলেন মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে যা পরে হয়ে ওঠে এএমইউ। তিনি ১৯২৯ সালে বছরে ২ টাকা দরে এএমইউকে ৩.০৪ একর জমি লিজ দিয়েছিলেন বলে তথ্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের‌ই ওয়েবসাইটে। রাজার পরিবারের বর্তমান সদস্যরা এখনও কিলার পাশে আধুনিক শৈলিতে নির্মিত বাংলোয় থাকেন।‌ মার্কসবাদী লেখক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজ সংস্কারক মহেন্দ্র প্রতাপের বাড়িটি এমনিই পড়ে আছে। কোনো সংস্কার নেই অথচ সরকার চাইলে এর রক্ষণাবেক্ষণ করে পর্যটক স্থল বানাতে পারতো। এরকম পুরনো কিলায় আসলে মনে হয় আমাদের দেশ কত মহান। এরকম ধর্ম নিরপেক্ষ সুসন্তানদের জন্য‌ই দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিলার ভেতরে যাওয়া গেলনা। রাজ্যের যত কাঁটা থাকা ঝোপঝাড় আর ধুতরার গাছ। কিলার ভাঙ্গা ছাদ থেকে মাথায় ইট পাথরের টুকরো পড়ার ভয়ে ভেতরে যাওয়ার লোভ সংবরণ করলাম। আর ভেতরে সাপ তো নিশ্চয়ই থাকবে।
মুরসান বাজারে গেলাম। হিন্দু ধর্মে মহিলাদের উদযাপিত করবাচৌথ পূজা আসছে। মহিলারা স্বামীর দীর্ঘজীবন কামনা করে এই ব্রত রাখেন। বাজারে বিভিন্ন ধরনের পসরা। আমাদের অঞ্চলে যেভাবে ঈদ বা দূর্গা পূজার আগে কাপড় চোপড় বিক্রি হয় এখানে করবাচৌথেও এমন হয়।‌ বাজারে চিনির নির্মিত সাদা ঘটিও দেখলাম। জানিনা এটি কী কাজে আসে।
মুরসানে আর কিছুই নেই। সাদামাটা গ্রাম্য জায়গা। তবে এখান থেকে আলিগড় ও আগ্রা পাশেই। মুরসান বাজার ছুঁয়ে গেছে যমুনা এক্সপ্রেস‌ওয়ে যা খুব কম সময়ে উত্তর প্রদেশের এই অঞ্চলের সাথে দিল্লিকে যুক্ত করে। আমার সময় নেই। আর আগ্রায় আগেও‌ গেছি। আগামীকাল‌ই আহমেদাবাদ চলে যাবো তাই আজ আঙ্কেলের গ্রামেই থাকবো বলে ঠিক করলাম।
বিকেলে আঙ্কেলের সাথে বাজারে গেলাম। ভিড় নেই। আমাদের অঞ্চলে যেভাবে বেকার ছেলেরা বসে আড্ডা দেয় এরকম কিছুই নজরে পড়লো না।‌ ফুচকা খেয়ে এটিএম থেকে টাকা উঠিয়ে চলে এলাম। আগামীকাল সকালেই দিল্লি চলে যাবো। দিল্লি থেকে শুকিয়ে যাওয়া অনুর্বর সাবরমতির পারের কংক্রিটের শহর আহমেদাবাদ। শেষ হলো কলম্বাস ডে'র ছুটি।
(সমাপ্ত)

Comments

Popular posts from this blog

দেশ বিদেশের গল্প

বাইশটি ভাষার পণ্ডিত ড° মহম্মদ শ্বহীদুল্লাহের বিষয়ে...

প্রবাসের ডাক