দেশ বিদেশের গল্প
এর আগে প্রবাসের নাম দিয়ে আমার নিজেরই অখাদ্য কাহিনী শুনিয়েছি অনেকদিন। ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা ক্রমশঃ লিখে যাওয়া কঠিন। অন্তত আমি সহজেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। তবে লেখা শুরু করায় বাংলার চর্চা ভালোই হয়েছে। বারবার কাটাকুটি করেছি যাতে মনের কথা ঠিকঠাক বোঝাতে পারি। কখনো অনেকের ভালো লেগেছে আর কখনো খারাপ পেতে পারি ভেবে সত্যিকারের ফিডব্যাক দেননি অনেকেই। এবার আরও বেশি চেষ্টা করবো যাতে সাদামাটা ঘটনাবলী সাজিয়ে তুলতে পারি। তাই নতুন উদ্দীপনায় আবার শুরু করছি। ধরে নিন এরই মাধ্যমে লেখালেখি শিখছি। বেশিরভাগ ভুলে গেছি। যা মনে আছে তা জোড়াতালি লাগিয়ে লেখব। শুরু করব আজকের সময় থেকে। ক্রমে পুরনো দিনের কথাও লেখব। আমারই জীবনের আধো আলো আধো ছায়ার কথা।
নাম থাকুক - দেশ বিদেশের গল্প। আজ প্রথম পর্ব
++++++++++++++++++++++++++++++++++
দিল্লির ডমেস্টিক টার্মিনালে ফ্লাইট লেন্ড করার সঙ্গে সঙ্গে সাঙ্ঘাতিক বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ইংরেজিতে যাকে ক্যাটস এন্ড ডগস বৃষ্টি বলে ঠিক সেরকম। থামার নাম নেই। চলছে তো চলছেই। কেপ্টেন ঘোষণা করলেন কিছুক্ষন বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এই বৃষ্টিতে প্লেনে ফুট পেডেল লাগানো যাবে না আর লাগেজ বের করলে সব ভিজে যাবে। কিচ্ছু করার নেই। এদিকে আমার খুব মাথা ব্যাথা হচ্ছে। গুয়াহাটি পর্যন্ত বাসে এসেছিলাম। জানালার পাশের সিটে বসেছিলাম। সারাটা পথ মুখের উপর রোদ পড়ছিল। ফলাফল অসহ্য মাথাব্যথা থামতে চাইছে না। ভাবছিলাম এয়ারপোর্ট থেকে পেইন কিলার কিনে খাবো। কিন্তু এখন ফ্লাইটেই বসে থাকতে হবে বৃষ্টি কম না হওয়া অবধি। কতক্ষন কেউ জানে না। বাড়িতে যতদিন ছিলাম বৃষ্টি হয়নি। সাঙ্ঘাতিক গরমে পনেরো দিন কাটিয়েছি। রোজ ভাবতাম, আজ বৃষ্টি হবে আর আমি খালি গায়ে বৃষ্টিতে ভেজার স্বাদ উপভোগ করবো। কিন্তু না, একদিনও বৃষ্টি হলোনা। আর আজ আমি যখন চলে যাচ্ছি তখন কি যে বৃষ্টি। যেন আমাকেই ভেংচি কাটছে। কপাল মন্দ আর কি!
ফ্লাইট লেন্ড করায় সবাই মোবাইল অন করে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। আমার সিম কার্ড এতিসালাত কোম্পানির। ইউএই থেকে নেয়া কানেকশন। এতদিন ভালোই নেটওয়ার্ক ছিল। থ্রিজিও ফুল স্পীডে চলছিল। কিন্তু গতকাল থেকে সমস্যা শুরু হয়ে গেছে। নেটওয়ার্ক দেখাচ্ছে না। তাই চোখ বন্ধ করে বসে আছি।
"শুনছেন?"
চোখ খুলে দেখি পেছনের সিটে বসা ভদ্রমহিলা আমাকেই বলছেন। আমি যে বাঙ্গালী উনি কি করে জানলেন!
"হ্যা, বলুন।" - ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম।
মুহূর্তের জন্য ভাবলাম ভদ্রমহিলার কি চাই কিন্তু এর আগেই উত্তর এলো: "আপনার ফোনটা দেবেন? একটা কল করতে হবে।"
বললাম আমার মোবাইলে নেটওয়ার্ক আসছে না।
চল্লিশোর্ধ বয়সের মহিলা কালো আর হলুদ রঙ্গের শাড়ি পরে আছেন। আমার দিকে চোখে চোখ রেখে তাকালেন। ওনার বিশ্বাস হচ্ছে না নিশ্চয়ই। হয়তো ভাবছেন ব্যালেন্স কাটা যাবে তাই আমি মোবাইল দিচ্ছি না। আমি বোঝাতে গেলাম, এটা লোকেল সিমকার্ড নয় আর গতকাল থেকেই সমস্যা হচ্ছে। বলার আগেই উনি চলে গেলেন। বলা হলো না। আসলে আশপাশের সবাই নিজেদের ফোন নিয়ে ব্যস্ত। আমিই ফ্রী বসেছিলাম। সেজন্যই ভদ্রমহিলা আমার মোবাইলটি চাইছিলেন। আমি আবার চোখ বুঝলাম।
প্রায় আধঘণ্টা পর বৃষ্টি কমে এলো। প্যেসেঞ্জার নামা শুরু করলেন। সবার শেষে আমি নামলাম। পাঁচ নম্বর বেল্টে চেক-ইন করা লাগেজ দেয়া হবে। আমার ছোট্ট একটি ব্যাগ। তাই ট্রলি নিলাম না। বেল্টের পাশে গিয়ে দেখি ঐ ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন আর এদিক ওদিক দেখছেন। পাশে গিয়ে দাড়াতেই বললেন ওনাকে একটি ট্রলি এনে দিতে। নিয়ে এলাম। আমি আর ওনি আমাদের ব্যাগের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার ব্যাগ অগেই এসে এলো। ভাবলাম ওনার ব্যাগগুলো বেল্ট থেকে নামিয়ে ট্রলিতে উঠিয়ে দিয়েই যাবো। ওনার একটি ব্যাগ আর দুটো কার্টন। অনেকক্ষণ দাঁড়াত হলো। আমার মাথা ব্যাথাও কমার নাম নিচ্ছে না। অবশেষে ওনার লাগেজ এলো। ট্রলিতে উঠিয়ে দিয়ে আমি মেডিকেল স্টোর খুঁজতে লাগলাম।
আমাকে তিন নম্বর টার্মিনালে যেতে হবে। রাত দেড়টায় ফ্লাইট। এখনও অনেক সময় আছে। অষুধ খেয়ে চা খেলাম। এরপর শাটল বাসে বসে সোজা পৌঁছে গেলাম টি-ত্রী টার্মিনালে । এখনও মাত্র আটটা। এগারোটার আগে চেক-ইন শুরু হবে না। তিন ঘন্টা বসে থাকতে হবে। এক বোতল পেপসি নিয়ে ডিপার্চার হলের কোনার দিকে একটি সোফায় বসে পড়লাম। একটু পর ওয়েটিং হলে দেখি ঐ ভদ্রমহিলাও বসে আছেন। আমাকে দেখতে পেলেন। কথা হলো। উনিও দুবাই যাচ্ছেন। একটি নতুন চাকরিতে যোগ দিতে। কিছুটা আশ্চর্য লাগলো। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের মহিলা একা আরেক দেশে যাচ্ছেন নতুন চাকরি করতে। উনিই খুলে বললেন। পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। আর ছেলে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব দুবাইয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছে। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগে। মুল বাড়ি আসামের শিলচরে। ভদ্রমহিলা দিল্লিতে এক বেসরকারি কোম্পানীতে ওয়েব ডিজাইনার ছিলেন গতমাস পর্যন্ত। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুবাইয়ে চাকরি পেয়েছেন। ইচ্ছে ছেলের সাথে থাকবেন। ছেলেরও ইচ্ছা হোস্টেলে না থেকে মায়ের সাথে থাকবে। শুনে খুব ভালো লাগলো। এই বয়সেও ছেলে আর মা একসাথে থাকবেন। চাকরি আর পড়াশোনা একসাথে চলবে। দারুন তো। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। আমি যাতে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাই তার জন্য রাত জেগে দোয়া করবেন আমার মা। আচার, পিঠে ইত্যাদি দিয়ে বেগ ভর্তি করে দিয়েছেন আমার। ইচ্ছে না থাকলেও নিয়ে এসেছি। এই কদিন বাড়ির কথা খুব মনে পড়বে।
যথারীতি চেক-ইন কাউন্টারে লাইন দিলাম। আমার আগে দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রমহিলা। উনি পাসপোর্ট আর টিকিট কাউন্টারে এগিয়ে দিলেন। কাউন্টারে বসা মেয়েটি ভদ্র মহিলার নাম কনফার্ম করল - মৌসুমী রায়। মৌসুমী শুনতেই চমকে উঠলাম।
'মৌসুমী' - যখনই শুনি চমকে উঠি। মৌসুমী এক অস্বাভাবিক নাম। আসামের করিমগঞ্জ জেলার মৌসুমী তাপাদার। কখনও ভুলতে না পারা এক চিরসবুজ সময়ের আখ্যান। এই নাম শুনলেই মনে পড়বে ২০০২ সালের কথা। ১৬ বছর আগের কথা। যখনই এই নাম শুনব আমকে ডুবে যেতে হবে পুরনো দিনের স্মৃতির অথৈ জলে। সে মৌসুমীর সাদা কুর্তার ছবি হোক, জাসমিনের খুসবু থাকা সেন্টের হোক বা এক পিঠ কালো চুলের কথা হোক, ভুলা যাবে না। মনে পড়বে তরতরিয়ে ক্লাসে আসতে থাকা একটি ছিপছিপে মেয়ের কথা। জেনারেল ক্লাসে আসছে মৌসুমী। আমি দুতলা থেকে দেখছি। অথবা আমি আগেই পৌঁছে গেছি মেজরের ক্লাসে। ওর দেরি হয়ে গেছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। ওর হাতে ছাতা নেই। সাদা রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বাঁশ আর টিন দিয়ে বানানো অস্থায়ী মেজরের ক্লাসে ঢুকছে ও। কলেজের রিনোভেশনের কাজ থাকায় মাঠের ওপারে মেজরের ক্লাস। মুল বিল্ডিং থেকে অনেক দূর। কতদিন পেরিয়ে গেছে। বছরের বছর পর। কিন্তু মনে হয় কালকের কথা। মৌসুমীর কথা মনে থাকবেই। ভুলা যায় না।
এরপর মনে পড়বে কেন্টিনের কথা। আমি বসে আছি একা। আলু চপ আর চা খাচ্ছি। তখন মৌসুমী আসবে। সাথে আরও পাঁচ ছয়টি মেয়ে। ইমরানা, সালমা, পাপিয়া, অনামিকা, উত্তরা। এই ছিল মৌসুমীদের গ্রুপ। সবাই ইংরেজি মেজর। আমারই সহপাঠী। কিন্তু মেয়েদের আলাদা গ্রুপ। আর ছেলে বলতে আমরা পাঁচ ছয়জন। এর মধ্যে কেবল অমিই দূরের মানুষ। বাড়ি আমার অন্তত পঞ্চাশ কিলোমিটার দুরে। তাই কলেজের পাশে এক বাড়িতে ভাড়া ঘরে থাকা। হাতে সময় আর সময়। তাই ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও সন্ধ্যা অবধি কেন্টিন বা লাইব্রেরীতে বসে থাকা রোজকার কথা। মৌসুমী মানে যেন এক পশলা দমকা হাওয়া। রঙ্গ বেরঙের একঝাঁক প্রজাপতি বা পাখি। কলকল শব্দে বেয়ে চলা পাহাড়ি নদী। মৌসুমী আর তার সখীরা গরম গরম সিঙ্গাড়া কাগজে ঠোঙ্গায় ভরে নিয়ে চলে যাবে। আর কেন্টিনের কোনায় বসে থাকা আমি ঠান্ডা চা বদলে দেয়ার জন্য বাসবদাকে ডাকাডাকি করবো।
মৌসুমী নাম শুনলেই মনে আসবে হোসেন স্যারের ঘরে টিউশনে যাওয়ার কথা। আমি নোট ডিকটেট করে যাবো আর মৌসুমীরা লিখে যাবে। চছার থেকে মিলটন, জন ডান থেকে এলিয়টস কিংবা ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে কিটস্। আমার চোখে সাদা কুর্তা আর পাজামা পরা ছিপছিপে মৌসুমী। জাসমিনের এ কোন্ সেন্ট যা নেশা ধরিয়ে দেয়। হোসেন স্যারের বেডরুম থেকে আসা এক অজানা শিল্পির কন্ঠে রবী ঠাকুরের গান - কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা, তাই দিয়ে যায় বেলা.... । আর এভাবেই দিন চলতে থাকা। থ্রী ইয়ার ডিগ্রি কোর্সের প্রথম দুটি বছর। সবকিছু মৌসুমীময়। দুই বছরে কলেজে মোট ক্লাস হয়তো দুশ দিন হয়নি। কিন্তু আমি আর মৌসুমী কাটিয়েছি অনেক দিন। যেন দুই যুগ।
আমরা একসাথে দু'বছর ছিলাম। যেন দুটি যুগ ধরে একসাথে ছিলাম। আমরা খালি একসাথে পড়তাম। কখনও ঘুরতে যাইনি। খালি একবার আমি অসুস্থ থাকায় ও আমার রুমে এসেছিল। ব্যস এতটুকুই। মৌসুমী থাকতো মাথায়, চিন্তায়, ২৪ ঘন্টা। ক্লাস শেষ হয়ে গেলে আরেকটা দিন যেন আসতে চাইতো না। তাই সময় কাটাতে কলেজ শেষ হলে কখনো কখনো শ্রীমা টি স্টলে রুটি খেয়ে চলে যেতাম কাটিগড়া চৌরঙ্গী অবধি । সাইকেল চালাতাম একা একা - স্টেশন রোড থেকে জুমবস্তি, খাদিমপাড়া থেকে বদরপুর ঘাট। মাথায় একজনের ছবি ঘোরপাক খেতো - মৌসুমী। সম্ভবত মৌসুমীকে ভালোবাসতাম।
সে ২০০২ সালের কথা। আমি বদরপুরের নবীন চন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। এতদিন করিমগঞ্জ কলেজে ছিলাম। কিন্তু ইংরেজি মেজরে সিট না পাওয়ায় বদরপুরে আসা। ফর্ম ফিলাপের দিনই মৌসুমীর সাথে পরিচয়। ভর্তি হয়ে যাওয়ার পর সবাইকে ইংরেজি মেজরের জন্য আলাদা একটি টেস্ট দিতে হবে। সেই ভর্তি পরীক্ষায় একই বেঞ্চে আমরা পরীক্ষা দিতে বসলাম। পরীক্ষা নিচ্ছিলেন হোসেন স্যার।
আমরা লাইনের আগেই ছিলাম তাই তাড়াতাড়ি চেক-ইন ফর্মালিটি হয়ে গেল। ব্যাগ জমা দিয়ে হাতে বোর্ডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশন এরিয়ায় গেলাম। এসি ফুল স্পীডে চলায় ঠান্ডা লাগছিলো। ইমিগ্রেশন অফিসার আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে স্ট্যাম্পিংয়ের জন্য খালি পাতা খুঁজছিলেন। কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলেন সম্ভবত। অনেক বেশি যাওয়া আসা হওয়ায় পাসপোর্টের পাতা প্রায় শেষ। আগামী বছর দেশে ফিরলে নতুন পাসপোর্ট নিতে হবে। গতানুগতিক দু-একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেই অফিসার যেতে দিলেন। এখনও বোর্ডিংয়ের দুঘন্টা বাকি। ডিউটি ফ্রি এরিয়ায় এসে বসার জায়গা খুঁজতে লাগলাম। একটি রেক্লাইনার চেয়ার পেয়ে গেলাম। ভাবলাম মোবাইলে গেম খেলে সময় কাটাবো। কিন্তু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে মৌসুমীর কথা। স্কুল কলেজের বন্ধুদের কথা। আমাদের সময় বন্ধু বান্ধব থাকতেন না। খালি বন্ধুই থাকতেন। এমনই ছিল আমার ছোট্ট বারইগ্রামের পরিবেশ।
যখন ক্লাস এইটে ভর্তি হই তখন খুব সহজ সরল ছিলাম। পড়াশোনা আর খেলাধুলার বাইরে যে একটি জগত আছে তার সাথে খুব একটা পরিচয় ছিল না। দুনিয়ার অনেক কিছু বোঝতাম না। জফড়গড় হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হয়ে আমার মতো অনেক বোকাসোকা ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হলো। বন্ধুত্ব মানে এক বেঞ্চে বসা, নোট শেয়ার করা আর ছোটোখাটো খুনসুটি করা। একবার এক সহপাঠী মেয়ে ওর ছোটো ভাইকে নিয়ে স্কুলে এলো। টি-শার্ট পরে এসেছিল ছেলেটি। আর টি-শার্টে লেখা ছিল ইংরেজিতে ৭৫। আমরা কয়েকজন মিলে ঐ মেয়েকেই সেভেন্টি ফাইভ ডাকনাম দিয়ে দিলাম। ও ক্লাসে এলেই আমরা একসাথে বলে উঠতাম - সেভেন্টি ফাইভ। প্রথম প্রথম ও রেগে উঠতো আর আমরা মজা পেতাম। কিন্তু শীঘ্রই ও ইগ্নোর করা শুরু করে দিল। আমি আর আমার এক বন্ধু নতুন বুদ্ধি বের করলাম। একরাতে আমি আর আমার বন্ধু ছোট ছোট কাগজের টুকরো বানিয়ে তাতে রাত জেগে ইংরেজিতে ৭৫ লিখলাম। প্রায় পাঁচ ছয়শো কাগজের টুকরোয় ৭৫ লিখে আনলাম। পরের দিন সকাল সকাল স্কুলে এসে সব জায়গায় এই কাগজের টুকরো ছড়িয়ে দিলাম। সবকটি ক্লাসের সামনে, রাস্তায়, অডিটরিয়ামে, অফিসের সামনে এমনকি স্কুলের ছোট্ট খেলার মাঠে ছড়িয়ে দিলাম এই ৭৫ লেখা কাগজ। যখন স্কুলের সময় হলো আর শিক্ষক ছাত্ররা ক্লাসে আসা শুরু করলেন তখন সবাই যেদিকে দেখছেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে ৭৫। কেউ কিচ্ছু জানে না এই ৭৫ এর রহস্য কি। ৭৫ এর ছয়লাপ সবদিকে। একটু পরেই আমাদের টার্গেট ক্লাসে এলো। বুঝে ফেললো এটা আমার কাজ। কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে সোজা প্রিন্সিপালের অফিসে। প্রিন্সিপাল ডেকে নিয়ে বেদম পেটালেন আমি আর আমার বন্ধুকে। রাগে আর অপমানে খুব কাঁদলাম। এটাই ছিল স্কুলে প্রথম ও শেষ মার খাওয়ার ঘটনা। আমি আর আমার বন্ধু স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতিজ্ঞা করলাম যে বড়ো হয়ে যখন চাকরি করবো তখন এর বদলা নেয়া হবে। আজ ঐ সবুজ দিনগুলোর কথা দিল্লির টি-ত্রি ডিউটি ফ্রি এরিয়ায় বসে মনে পড়ছে আর হাঁসি পাচ্ছে। ঐ মেয়ে আর আমার বন্ধুর নাম ইচ্ছে করেই বলছি না। আমার সহপাঠী মেয়েটি এখন ওকালতি করে কিন্তু যোগাযোগ নেই। কখনও দেখা হলে স্যরি বলবো। হয়তো ওসব ওর মনেই নেই। আর কেনোই থাকবে! প্রায় বিশ বছর আগের অনেক কথা তো আমি নিজেই ভুলে গেছি।
মৌসুমী রায়কে দেখতে পেলাম। ডিউটি ফ্রি থেকে কেনাকাটা করছেন। কিছুক্ষণ পরে আমাদের বোর্ডিং ঘোষণা হয়ে গেল। ১৮ বি গেইট থেকে আমাদের বোর্ডিং হবে। আমি এগিয়ে গিয়ে মৌসুমী রায়কে এনাউন্সের কথা বললাম। একসাথে চলতে লাগলাম ১৮ নম্বর গেটের দিকে। ভদ্রমহিলার জিনিস একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। আর কেবিন লাগেজ সাত কেজির ঊর্ধ্বে হলে আলাদা টাকা দিতে হয়। ভদ্রমহিলা কি করবেন ভাবছিলেন। আমার ব্যাকপেকে অনেক জায়গা। খালি একটা ম্যাকবুক আর মোবাইল চার্জার। মোট দুই কিলোর বেশি নয়। তাই ওনাকে বললাম কিছু প্যাক করা জিনিস আমাকে দিতে পারেন। উনি চকোলেট, বিস্কুট আর কয়েকটি মশলার প্যাকেট আমাকে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বোর্ডিং হয়ে গেলে এই জিনিস আবার ওনার বেগে ঢুকাতে পারবেন। ভদ্রমহিলার সিট ছিল ১৩এ আর আমার ২২এফ। তাই বিমানে ঢোকার আগে ওনার জিনিস দিয়ে দিলাম। সিটে বসে চোখ বন্ধ করলাম। একটু ঘুমোতে পারলে ভালো হয়। তিন ঘন্টায় দুবাই পৌঁছে যাব। কিন্তু ঘুম আসছিলো না। মনে পড়ছিলো স্কুলজীবনের কথা।
আমার হাইস্কুল ছিল খুব সাদামাটা। বেশিরভাগ বন্ধুদের সাথে এখনোও যোগাযোগ আছে। কেউ ব্যবসা করছেন, কেউ বা সরকারি চাকরি আর কেউ প্রবাসী। যতদিন এগিয়ে যাচ্ছে এদের সঙ্গে যদিও পার্থিব দুরত্ব বাড়ছে তবুও মনের টান এখনও আছে। এই মুহূর্তে আমি বারইগ্রাম থেকে প্রায় দু হাজার কিলোমিটার দুরে আর তিন ঘন্টা পর এই দুরত্ব হয়ে যাবে চার হাজার কিলোমিটার।
এইচএসসি পড়ার জন্য ভর্তি হলাম করিমগঞ্জ কলেজে। বাড়ির সবাই বলছিলেন সায়েন্স নিতে কিন্তু আমার আর্টসের প্রতি ঝোঁক ছিল। বাংলা মাধ্যমের স্কুল থেকে এলাম ইংরেজি মাধ্যমের করিমগঞ্জ কলেজে। বারইগ্রাম থেকে দুরত্ব ২৩ কিলোমিটার। হস্টেলে থাকবো ঠিক হলো। কলেজের হোস্টেলে রিগিং হতে পারে তাই আব্বার পরামর্শ অনুযায়ী করিমগঞ্জের হাদারগ্রাম মসজিদ সংলগ্ন হস্টেলে বেড নিলাম।
বোর্ডিং কম্প্লিট। বিমান এখন রানওয়েতে। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্কেতের অপেক্ষায়। এর পর তীব্রগতিতে পাইলট রানওয়ের উপর প্লেন চালিয়ে এক ঝটকায় উড়িয়ে দেবেন আকাশে। সিট বেল্ট বাঁধার আর মোবাইল অফ করার সময় হয়ে গেছে।
কেপ্টেন সিটবেল্টের সঙ্কেত বন্ধ করে দিয়েছেন। সম্ভবত বিমান অটোপাইলটে রাখা হয়েছে। এখন মাথায় ঝিমঝিম করবে। কানে ব্যথাও করতে পারে। কেবিন প্রেসারের জন্য অনেকের এই সমস্যা হয়। এরপর শুরু হবে জলপান। পৃথিবীর মাটি থেকে ৩৫০০০ ফুট উপরে চলমান রেস্তোরাঁ। স্বভাবতই বিরক্তিকর। কিন্তু এরমধ্যেও অনেকেই হামলে পড়বেন। যেন জন্ম জন্মান্তরে খাওয়া হয়নি। স্বাদহীন অখাদ্য চেটেপুটে খাবেন। বাতি নিভিয়ে দিলে একটু ঘুমোতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু না, অন্তত এক ঘন্টা এয়ার হোস্টেসরা ডবল দামে আলতু ফালতু বস্তু বিক্রি করবেন। আর আমাকে দাঁত চিবিয়ে বিরক্তি লুকিয়ে রাখতে হবে।
করিমগঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়ে সম্পুর্ন আলাদা এক পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় হলো। কাউকে চিনি না। একদিন হালকা রিগিং হয়ে গেলো। তবে সিনিয়ররা খালি প্রশ্ন উত্তর করছিলেন। ইন ফেক্ট, রিগিং বলা ভূল হবে। সাধারণ প্রশ্নোত্তর আর পরিচয় পর্ব। কুমার (নাম পরিবর্তিত, আজকাল ও বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা) বলে এক সহপাঠীকে এমন প্রশ্নোত্তর করায় ঝগড়া বেধে গেল সিনিয়রদের সাথে। আমরা একদিকে দশ বারো জন আর অপরদিকে ডিগ্রির প্রায় বিশ পঁচিশ জন। পরে বোঝলাম একদিকে এনএসইউআই সমর্থক আর একদিকে এভিবিপির সমর্থক। একটু ধাক্কাধাক্কি শুরু হতেই ইউনিয়নের ছেলেরা দৌড়ে এসে মিটমাট করে দিয়ে গেলো। এর পর আর করিমগঞ্জ কলেজে আমি যতদিন ছিলাম ততদিন রিগিংও হয়নি আর ঝগড়াও হয়নি।
আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন প্রয়াত ডঃ কামাল উদ্দিন আহমেদ স্যার। খুব ভয় করতাম। একবার আমি আর আরেক বন্ধু ক্লাস ছেড়ে কলেজের গেটের পাশে আড্ডা দিচ্ছিলাম। স্যার দেখতে পেলেন আমাদেরকে। ওনার সাদা এম্বেসেডারের কাচ নামিয়ে এক ধমক দিলেন। আমরা দৌড়ে এসে ক্লাসে ঢুকলাম। ভাগ্যিস যে অধ্যাপিকা পলিটিকাল সাইন্স পড়াচ্ছিলেন ওনার নজর এড়িয়ে পেছনের দিকে বসতে পেরেছিলাম। এর পর স্যারের সাথে একবার ওনার কানিশাইলে অবস্তিত বাড়িতে গিয়ে দেখা করি।
হায়ার সেকেন্ডারি ফাইনালে ভালো মার্কস ছিল না। বড় ইচ্ছা ছিল ইংরেজি সাহিত্যে মেজর নিয়ে ডিগ্রি করবো। কিন্তু লিস্টে নাম এলোনা। এক সহপাঠী পরামর্শ দিলেন প্রিন্সিপাল স্যারের বাড়িতে গিয়ে অনুরোধ করতে। আমি তো মুসলমান, স্যারও মুসলমান। হয়তো এর জন্য একটি সুযোগ পেয়ে যাব। কাজ হলো না। স্যার উল্টো রেগে গেলেন। পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন নম্বরের উপর ভিত্তি করে মেরিট লিস্ট বানানো হয়েছে। এতে আমি মুসলমান এর জন্য কোনো আলাদা সুযোগ থাকবে না। আমি করিমগঞ্জ কলেজে অনার্স পড়ার সুযোগ পেলাম না ঠিকই কিন্তু স্যারের প্রতি সন্মানবোধ বেড়ে গেল। এখনও স্যারের ঐ দুই এনকাউন্টারের সময়ের চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আজ স্যার আমাদের মাঝে নেই। ঈশ্বর উনার আত্মার মঙ্গল করুক, এটাই প্রার্থনা।
করিমগঞ্জ কলেজে ইংরেজি অনার্সে সিট পাবো না আর পাস কোর্স করার ইচ্ছে নেই। এখন কি করব! অনেকের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। জানতে পারলাম বদরপুর নবীনচন্দ্র কলেজে অনায়াসে চ্যান্স পেয়ে যাব। গেলাম সেখানে। প্রথমে এডমিশান নিতে হবে এরপর মেজরের জন্য আলাদা করে এডমিশান টেস্ট হবে। জানতাম না এই কলেজে আমার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে।
বাড়ি থেকে বদরপুর অনেক দুর। নবীন চন্দ্র কলেজে পড়তে হলে বদরপুরে পিজি করে থাকতে হবে। প্রথম দিন এডমিশান নিয়ে ভাড়া ঘরের খোঁজ করলাম। কোথাও কোনো আশানুরূপ ফল পেলাম না। পরের দিন মেজরের জন্য ভর্তি পরীক্ষা। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন ছাত্র ইতিমধ্যে পরীক্ষার হলে উপস্থিত। আসন সংখ্যা মাত্র বিশ। আমি গিয়ে প্রথম বেঞ্চ খালি পেয়ে এক সাইডে বসে পড়লাম। সবাই মিলে চিৎকার চেঁচামেচি করছিল।
পরীক্ষার হলে প্রবেশ করলেন হুসেইন স্যার। আলপিন পতন নৈঃশব্দ্য। প্রথম দর্শনেই স্যার যে একজন সম্মানিত আর খোশমেজাজে ব্যক্তি বোঝলাম। সবার সাথে পরিচয় পর্ব সেরে স্যার আমাদেরকে পরীক্ষার স্কিম বোঝালেন। দুটো প্রশ্ন থাকবে। কেন ইংরেজি মেজর নিতে আগ্রহী আর যেকোনো একটি প্রিয় বইয়ের বিষয়ে লিখে দিতে হবে। রচনা লেখার ধরন দেখে হুসেইন স্যার কয়েকজনকে শর্ট লিস্ট করবেন আর মৌখিক পরীক্ষা নেবেন। সবচেয়ে ভালো বিশ জন ছাত্র এবছরের মেজর কোর্সে ভর্তির সুযোগ পাবেন। স্যারের সঙ্গে আসা একজন সহকারী সবাইকে উত্তর লেখার জন্য সাদা কাগজ ভাগ করে দিলেন। সবাইকে প্রশ্ন দুটি লিখে নিতে বললেন স্যার। উত্তর দেয়ার জন্য সময় থাকবে এক ঘন্টা। পরীক্ষা শুরু হতেই এক মিস্টি গলার ক্ষীণ আওয়াজ কানে এলো। সাদা চুড়িদার সালোয়ার পরা খোলা চুলের মালকিনের কন্ঠ:
মে আই কাম ইন স্যার?
সবাই চোখ তুলে দেখলেন। আমিও। কেউকি এক লাইনের একখানা গান শুনিয়ে গেলো? না না, নাটক করছি না। ঐ সময় এমন লাগছিল যে এত মিষ্টি স্বরের কথা কখনও শুনিনি। সম্বিত ফিরে পেলাম যখন মেয়েটি আমি বসে থাকা বেঞ্চের ওপাশে বসে পড়লো। নাকে তীব্র এক পারফিউমের সৌরভ এসে লাগলো। জাসমিন!
হুসেইন স্যার নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন।
মায় নেম ইজ মৌসুমী তাপাদার। আয় এম ফ্রম পাঁচগ্রাম।
এই বলে মহাশয়া সাদা রুমাল দিয়ে কপালে জমে উঠা দুই বিন্দু ঘাম মুছলেন। এতক্ষণ মোটামুটি ভেবেই নিয়েছিলাম এডমিশান টেস্টের ঐ দুটি প্রশ্নের কি উত্তর লেখবো। কিন্তু এখন সব গুলিয়ে ফেলেছি।
ফ্লাইট মাঝে মাঝেই টারবুলেন্সের কবলে পড়ছিল। ঘুমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম কিন্তু ঘুম আসছিলো না। মনে পড়ছিলো কলেজের কথা। মৌসুমীর কথা।
নবীন চন্দ্র কলেজের দ্বিতীয় দিনেই মৌসুমী তাপাদারের সাথে পরিচয়। ওর বাবা কাগজকলে চাকরি করেন। মা বাবার এক মেয়ে মৌসুমী। আদুরে কিন্তু বুদ্ধিমতী। আসল বাড়ি কাছাড় জেলার উধারবন্দ নামক জায়গায়। মেজরের ভর্তি পরীক্ষায় একই বেঞ্চে বসে পরীক্ষা দিলাম আমি আর ও। ওর আসতে দেরি হওয়ায় প্রথমে পরীক্ষার নিয়ম বোঝতে পারে নি। আমি বলে দিলাম কিভাবে লিখতে হবে। ধন্যবাদ বলে হ্যন্ডশেক করে ম্যাডাম পরীক্ষায় মনোনিবেশ করলেন। একটুকরো হাঁসি।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর হোসেন স্যার পেপার নিয়ে চলে গেলেন। বিকেল তিনটায় মেরিট লিস্ট লাগানো হবে। এতে লেখা থাকবে যারা মৌখিক পরীক্ষার সুযোগ পাবেন তাদের নাম আর পরীক্ষার সময়। মৌসুমী সহ বাকি সবাই এদিক ওদিক চলে গেল। বোঝতে পারলাম আমি ছাড়া বাকি সবাই এই কলেজেই ইলেভেন আর টুয়েলভ পড়েছেন। কেবল আমি বাইরে থেকে এসেছি। লক্ষ্য করলাম মেয়েদের একটি গ্রুপ আর ছেলেদের দুতিনটে গ্রুপ আছে। আপাতত আমি কোনো দলে নেই। হলের বাইরে থাকা বেঞ্চে বসে রইলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল। সামনেই সবুজ মাঠ। মনোরম দৃশ্য। বসতে বসতে ঘুম পাচ্ছিল। ভাবলাম কেন্টিনে গিয়ে চা খাবো। তক্ষুনি পেছন থেকে কয়েকটি মেয়ের কথা বলার আওয়াজ পেলাম। উঠে দাঁড়াতেই মৌসুমী একেবারে কাছে এসে গেছে। নাকে জাসমিনের সুগন্ধ এসে ধাক্কা দিল।
-- কি নাম তোমার? পরীক্ষা কেমন হলো?
-- শরীফ আহমদ। পরীক্ষা ঠিকঠাক হয়েছে।
-- শরীফ আহমদ। পরীক্ষা ঠিকঠাক হয়েছে।
সাধারণ কথাবার্তা হলো। ওর নাকি পরীক্ষা ভালো হয়নি। তাই ইংরেজিতে চ্যান্স নাও পেতে পারে। একটু চিন্তায় আছে। আমার মতো ইংরেজি সাহিত্য নেয়ার মৌসুমীরও খুব ইচ্ছা। বললাম, কেন্টিনে যাচ্ছি চা খেতে। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। মাঠের ওপারে কেন্টিন। মৌসুমীও সঙ্গে এলো। ঘাসে জমে আছে বৃষ্টির জল। আমি পিছলে পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গেলাম। ম্যাডামের খুব হাসি পেল। আচ্ছা, কেউ হঠাৎ করে পড়ে গেলে বেশিরভাগ লোকই হেসে উঠে কেন?
দুটা বাজছে। আরও এক ঘন্টা কাটাতে হবে। কাঁচের গ্লাসে চা নিয়ে কেন্টিনের সামনে বসে রইলাম আমি আর মৌসুমী। ওর সঙ্গিনীরা কেউ নেই। সম্ভবত চলে গেছে। ও বসে রইল। ওকে বললাম আমি ভাড়ার ঘর খুঁজছি। রোজ রোজ এত দুর থেকে ক্লাস করতে আসা সম্ভব হবে না। ও বলল, শহরের পশ্চিম দিকে, স্টেশন রোড ক্রস করে একটু এগিয়ে গেলেই কয়েকটি গ্রাম আছে। আরামসে ভাড়া ঘর পাওয়া যাবে। ওর নাকি কয়েকজন ক্লাসমেট ঐদিকেই থাকে। জিজ্ঞেস করে আমাকে বলবে। ভালো কথা।
বৃষ্টি চলছে তো চলছেই। চুপচাপ বসে আছি। কথা বলার বিষয়বস্তু নেই। ভাবছিলাম আমি আবার মেরিট লিস্ট দেখে মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে বাস ধরে করিমগঞ্জ যেতে হবে। করিমগঞ্জ থেকে অন্য বাস নিয়ে আরও ২৩ কিলোমিটার। আজ বাড়িতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে। কাল সকালে এসে যে কোনো ভাবেই ভাড়া ঘর নিয়ে নিতে হবে। রোজ রোজ এত কষ্ট করা যায় না।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি কমে এলো। মৌসুমীও চলে গেল। আমি বসে রইলাম। তিনটার সময় অফিস সামনে ভীষণ ভীড়। সবাই মেরিট লিস্ট দেখতে এসেছে। চার নম্বরে আমার নাম এসেছে। আমি ভীড় ঠেলে বাইরে এসে দেখি মৌসুমী দাঁড়িয়ে আছে। ও দেখতে পারেনি লিস্ট। আমাকে জিজ্ঞেস করলো ওর নাম এসেছে কি না। আমি তো ওর নাম দেখিনি। আসলে ভুলে গেছি। 'দাঁড়াও' বলে আবার ঠেলাঠেলি করে ভেতরে গিয়ে দেখলাম ওর নামও এসেছে। সাত নম্বরে ওর নাম। বাইরে এসে বললাম। কিন্তু ও কেন জান খুশি হলো না। রাগ করে আছে?
জিজ্ঞেস করলাম: "কি হলো? তোমার নাম তো এসেছে। খুশি হওয়ার কথা!"
ও যেতে যেতে বললো, "তুমি প্রথমবার আমার নাম দেখোনি কেন?"
--"আমি ভুলে গেছিলাম"
--"এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?"
এই কথার কি উত্তর হতে পারে বোঝতে পারলাম না। ততক্ষন ও দুরে চলে গেছে। কোনো কারণ ছাড়াই কেন জানি আমার মন খারাপ হয়ে গেল গেলো। সত্যিই ওর নাম দেখতে প্রথমবার আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
জিজ্ঞেস করলাম: "কি হলো? তোমার নাম তো এসেছে। খুশি হওয়ার কথা!"
ও যেতে যেতে বললো, "তুমি প্রথমবার আমার নাম দেখোনি কেন?"
--"আমি ভুলে গেছিলাম"
--"এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?"
এই কথার কি উত্তর হতে পারে বোঝতে পারলাম না। ততক্ষন ও দুরে চলে গেছে। কোনো কারণ ছাড়াই কেন জানি আমার মন খারাপ হয়ে গেল গেলো। সত্যিই ওর নাম দেখতে প্রথমবার আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
মেরিট লিস্টে যাদের নাম এসেছে তাদের মৌখিক পরীক্ষা হবে পরেরদিন। আমার হাতে কোনো কাজ নেই। বৃষ্টিও হচ্ছে না। কলেজ প্রায় খালি। মৌসুমী সম্ভবত চলে গেছে। আমাকে বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে। গেটের সামনে যেতেই একটি ছেলে ওর বাইক নিয়ে আমাকে ক্রস করে থামলো। জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাচ্ছি। ও বললো আমাকে বাসস্ট্যান্ডে ছেড়ে দেবে। ওর নাম রেজাউল। ফিলোসফি মেজর। ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পড়লাম ওর ইয়ামাহা বাইকে।
রাস্তায় রেজাউলের সাথে কথা হলো। ওর আসল বাড়ি রাতাবাড়ী। এখানে ওর বোনের সঙ্গে থাকে। খুব অমায়িক ছেলে। আমি ভাড়াঘর খুঁজছি জেনে ও বললো আগামীকাল একবার বাইক নিয়ে খোঁজা যাবে। পাশাপাশি অনেক লোকের সঙ্গে ওর জানাশোনা আছে। সমস্যা হবে না।
বাস পেয়ে বসে পড়লাম। ভাগ্য ভালো জানালার পাশেই বসার সিট পেয়ে গেলাম। কলেজে আজ দুজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। মৌসুমী আর রেজাউল। করিমগঞ্জ কলেজ থেকে এই কলেজ ছোট হলেও আশাকরি এখানকার ছেলেরা বড় মনের। কে জানি আমাকে এই কথাটা বলেছিল। কয়েকদিন গেলে এমনিতেই বোঝা যাবে। বাসে বসে অনাগত দিনের স্বপ্ন দেখছিলাম আর বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল যেন থামবেই না। ড্রাইভার ক্যাসেট প্লেয়ারে কিশোরদার গান লাগিয়ে দিয়েছেন - "মানা জানাব নে পুকারা নেহি, ক্যা মেরা সাথ ভি গাওয়ারা নেহি..."
পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। অকস্মাৎ প্রবল ঝাঁকুনিতে চোখ খুললো। টার্বুলেন্সের কবলে ফ্লাইট। অন্তত চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট উপর-নিচ হচ্ছে আমাদের A370 মডেলের এয়ারবাস খানা। আমার দুতিন সিট আগে একটি বাচ্চা জোরে কাঁদতে আরম্ভ করে দিল। ভয় পেয়েছে নিশ্চয়।
টার্বুলেন্স মানে আকাশে হঠাৎ কেঁপে উঠবে উড়োজাহাজ। আর এরপর কাঁপতেই থাকবে, মনে হবে কোনও কিছু এসে আঘাত করছে ফ্লাইটটিকে। এমন মনে হবে জোরে উপর থেকে এক প্রাগৈতিহাসিক দৈত্য বার বার চেপে দিচ্ছে আপনার ফ্লাইট। এতে ভয়াবহ এক আতঙ্ক আরোহীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ফ্লাইটের ভেতরে ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটে। তবে বড় বিপদের কোনো আশঙ্কা থাকে না। টার্বুলেন্সের কারণে ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়েছে এমন একটিও উদাহরণ নেই। টার্বুলেন্স স্রেফ একটি বাতাসের চাপ, ঝড়ঝঞ্ঝা, জেট স্ট্রিম বা পাহাড়ের কাছাকাছি এলাকা থেকে উড়ে যাওয়ার জন্য হয়। আর তা প্রায় সব ফ্লাইটেই কমবেশি হয়।
অনেক ক্ষেত্রেই পাইলটরা আগে থেকেই জানেন কখন ও কোন আকাশে টার্বুলেন্স হতে পারে। তখন তারা আরোহীদের সিট বেল্ট বেঁধে নেওয়ার নির্দেশনা দিতে পারেন। এছাড়াও পাইলটদের কাছে, ফ্লাইট পূর্ববর্তী আবহাওয়া রিপোর্ট থাকে, ককপিটের রাডার থেকে তথ্য পাওয়া যায়, আর ওই অঞ্চলে উড়ে চলা অন্যান্য ফ্লাইট থেকেও তথ্য আসে ফলে সতর্ক থাকার সব সুযোগই থেকে যায়।
একটু পরেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেলো। আমি এয়ার হোস্টেসের কাছ থেকে জল চেয়ে খেয়ে নিলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ। মা ব্যাগে কাঁচের বয়ামে আচার ভরে দিয়েছেন। এত ঝাঁকুনিতে বয়াম না ভাঙ্গলেই রক্ষা। এখন সবকিছু শান্ত। আর হয়তো এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো দুবাই। ঘুম আসছিলো না। আজ এ কি হচ্ছে। কিছুতেই স্মৃতির নদী সাঁতরে কুলে উঠে আসতে পারছি না।
মেজরে অনায়াসেই ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম। মৌখিক পরীক্ষা সহজ ছিল। ইংরেজিতে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিয়ে সবার নজরে এসে গেলাম। এরপর হোসাইন স্যার সবার সাথে কথা বললেন। পরিচয় পর্ব হলো। আনঅফিসিয়াল ইন্ডাকশন বলা যেতে পারে। এগারো জন ছেলে আর নয়জন মেয়ে নিয়ে বিশ জনের ইংরেজি মেজরের ব্যাচ। আগামী তিন বছরের জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ একসাথে কাটাতে হবে। আজ্ঞে হ্যাঁ, মৌসুমীও সুযোগ পেয়েছে।
দুতিন দিন পর নিয়মিত ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। ইন্ডাকশন শেষ হওয়ার পর হল থেকে বেরিয়ে এসে রেজাউলকে খুঁজে বের করলাম। ভাড়াঘর খুঁজে বের করতে হবে। ও আমাকে বাইকে বসিয়ে সোজা শ্রীমা টিস্টলে নিয়ে এলো। ওর নাকি ক্ষুধা লেগেছে। জানি না আমার এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। চা বিস্কুট খেতে খেতে ভাবছিলাম আমি যে কলেজ থেকে বের হয়ে এলাম আর এখন চলে যাচ্ছি তা মৌসুমীকে বলে এলাম না। পরক্ষনেই ভাবলাম ওকে আবার কেন বলতে হবে! যদি ও জিজ্ঞেস করে কেন বলে যাইনি তখন কি বলব? কিন্তু ও কি জিজ্ঞেস করবে? এরচেয়েও বড় প্রশ্ন, আমি কোথায় যাই না যাই ও কেনইবা জিজ্ঞেস করবে! কি সমস্যা। আমি কি খুব বেশি ভাবছি?
রেজাউল শ্রীমা টিস্টলে শফিকদার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। শফিকদা বদরপুরের এক পরিচিত মুখ। পেশায় ঠিকাদার কিন্তু বড় অমায়িক। আর কাউকে সাহায্য করতে একপায়ে খাড়া। বললেন কালকের মধ্যেই পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার ব্যবস্তা হয়ে যাবে। বিকেলের মধ্যেই খবর পেয়ে যাব। রেজাউল আমাকে চায়ের দোকানে রেখে চলে গেল। ওর নাকি কিছু কাজ আছে। ও ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়।
আমি এখন পায়ে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে চলে যেতে পারি আর আবার কলেজেও যেতে পারি। কলেজে কোনো কাজ নেই। তবে আড্ডা দেয়া যায়। অতএব তাই করলাম। মেজরের কাউকে কোথাও দেখতে পেলাম না। হয়তো লাইব্রেরীতে নয়তো কেন্টিনে আছেন সবাই। লাইব্রেরীতেও খুব একটা সাড়াশব্দ নেই। ভেতরে গিয়ে দেখলাম মৌসুমী ওর এক বান্ধবী সুলতানার সাথে বসে আছে। সামনে একটি ছেলে। দুর থেকে ছেলেটিকে চিনতে পারছিলাম না। পাশে গিয়ে দেখলাম ও আমাদেরই ব্যাচমেট। অলোক ওর নাম। শ্রীগৌরী থেকে আসে। ওরা সব একসাথে এই কলেজেই হায়ার সেকেন্ডারি পড়েছে। তাই ওদের বন্ধুত্ব। আমি তো নতুন। একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। কিন্তু লক্ষ করলাম আমার আসা আর ওদের সাথে বসা অলোক পছন্দ করছে না। বোঝতেই উঠে পড়লাম। আমি যাই বলতেই মৌসুমী বললো - 'বসো পাঁচ মিনিট, আমরাও যাচ্ছি'। আমি বসলাম না। সোজা বেরিয়ে এলাম। ওরা সম্ভবত আমার দিকে চেয়ে আছে। কিছুটা কি অভদ্রতা হয়ে গেলো?
লাইব্রেরীর বাইরে একটু দাঁড়াতেই দেখি মৌসুমী আসছে। জাসমিনের গন্ধ নাকে লাগলো।
এসেই রাগতস্বরে:
--কি হলো? বললাম দাঁড়াতে!
--কেন? আমার লাইব্রেরীতে কোনো কাজ ছিল না।
--তাতে কি হলো? আমার জন্য পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে পারো না?
আমি কিচ্ছু বললাম না। ও আরও রেগে উঠলো!
--কই ছিলে তুমি? সারা কলেজ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পেলাম না।
আমি চুপ। রাগে ওর মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। আমি ভাবছিলাম ও এতো রাগ কেন করছে?
কিছুক্ষণ উভয়েই চুপ। এরপর ও আমার হাত টেনে ওর হাতে নিয়ে বলল "আয় এম স্যরি! জানি না তোমার উপর কেন এত রাগ উঠলো"
আমরা তখনও লাইব্রেরীর সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।
আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। জোর করে ধরে রেখেছে।
কি আশ্চর্য আমার চোখে জল! কেন, জানি না।
বললাম, 'আমি যাই'।
এসেই রাগতস্বরে:
--কি হলো? বললাম দাঁড়াতে!
--কেন? আমার লাইব্রেরীতে কোনো কাজ ছিল না।
--তাতে কি হলো? আমার জন্য পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে পারো না?
আমি কিচ্ছু বললাম না। ও আরও রেগে উঠলো!
--কই ছিলে তুমি? সারা কলেজ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পেলাম না।
আমি চুপ। রাগে ওর মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। আমি ভাবছিলাম ও এতো রাগ কেন করছে?
কিছুক্ষণ উভয়েই চুপ। এরপর ও আমার হাত টেনে ওর হাতে নিয়ে বলল "আয় এম স্যরি! জানি না তোমার উপর কেন এত রাগ উঠলো"
আমরা তখনও লাইব্রেরীর সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।
আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। জোর করে ধরে রেখেছে।
কি আশ্চর্য আমার চোখে জল! কেন, জানি না।
বললাম, 'আমি যাই'।
তখন অলোক আমাদেরকে ক্রস করে গেলো। ও আমার দিকে এমনভাবে দেখছে যেন খেয়ে ফেলবে। কিন্তু কেন? আমার কাছে সবকিছু ধাঁধার মতো লাগছে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম আমাকে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মৌসুমী বললো ওকে আগে বাসে উঠিয়ে দিতে। ওকে পাঁচগ্রামের বাসে উঠিয়ে দিতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমি একেবারে ভিজে জবজবে হয়ে গেছি।
তীব্র ঝটকায় চোখ খুললো। ফ্লাইট দুবাইর মাটি ছুঁয়ে দৌড়ে যাচ্ছে রানওয়েতে। প্রায় চারঘন্টার উড়ান শেষ হলো। মোবাইল অন করে বাড়িতে জানিয়ে দিলাম যে আমি ঠিকঠাক পৌঁছে গেছি। আসামের বাড়িতে ফোন লাগিয়ে যখন মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন শুনতে পাচ্ছিলাম গ্রামে ফজরের নামাজের আজান দেয়া হচ্ছে। আমাদের গ্রামের সেই পরিচিত মোয়াজ্জেন। আওয়াজ শুনলেই চেনা যায়।
দুবাইয়ে এখনও রাত শেষ হয়নি। প্রায় দুঘন্টা বাকি। এখন সব অধৈর্য হয়ে পড়বে নেমে যাওয়ার জন্য। এই হুড়োহুড়ি সব জায়গায় দেখি। দিল্লি হোক বা ডেনভার, মুম্বাই কিংবা মাদ্রীদ, বিমান থামার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীরা অসম্ভব তাড়াহুড়ো শুরু করে দেবে। এমনকি পায়ের উপর পা মাড়িয়ে সবার আগে নেমে যেতে চাইবে। এই দুই মিনিট অপেক্ষা ওদের সহ্য হয়না। এখানেই সব ভদ্রতাবোধ শেষ হয়ে যায়। আমার আগে থেকেই অভ্যাস, সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পরই আমি বেরোই। তাই সিটেই বসে রইলাম। ভাবছিলাম কলেজের কথা। আসামের ছোট্ট শহর বদরপুরের কথা।
শফিক ভাই কথা রেখেছিলেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরের দিন শ্রীমা টি স্টলে দেখা করলাম। আমাকে ওনার ডিজেল চালিত বুলেটে বসিয়ে নিয়ে গেলেন শহর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দুরের ছোট্ট একটি ছায়াঘেরা গ্রাম রুপসীবাড়িতে (গ্রামের নাম পরিবর্তিত)। হাইওয়ে লাগোয়া ঐ গ্রাম বড় সবুজ। কত বড় বড় গাছ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশেই যেন দিনরাত্রির প্রহরী। এক বাড়ির সামনে বাইক থামালেন শফিকদা। নেমে গিয়ে গৃহকর্তার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক ইলেকট্রিক অফিসে কাজ করেন। বাড়িতে একটি আলাদা রুম আছে। তাই পেয়িং গেস্ট দিতে রাজি আছেন।
সাধারণ মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবার। আমি ইচ্ছে করলে ওদের সাথেই খেতে পারি। থাকা আর খাওয়ার জন্য মাসে ১০০০ টাকা দিলেই হলো। আমি নাকি দেখতে ওনার ভাগ্নের মতো তাই ওনাকে মামা ডাকতে পারি। রুমও পছন্দ হলো। একখানা কাঠের সিঙ্গল বেড, একজোড়া চেয়ার টেবিল, বইপত্র রাখার জন্য একটি আলমারি আর কাপড় রাখার জন্য কাঠের আলনা। ঘরের পশ্চিম দিকের দরজা খুলে দেখি কচুরিপানার আড়ালে লুকিয়ে আছে শান্ত সৌম্য ছোট্ট একটি পুকুর। কি সুন্দর দৃশ্য। জানালা খুললেই সবুজ আর সবুজ। কংক্রিটের এই শহর থেকে দূরে যেন গ্রাম বাংলার এক ছোট্ট জনপদের ওপাশে অপেক্ষমান বনানী। সঙ্গে সঙ্গে পছন্দ হয়ে গেল। গৃহকর্তা ওনার স্ত্রী আর ছয় বছরের ছেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরাই হয়ে গেলেন আমার অস্থায়ী মামা মামী আগত দুই বছরের জন্য। আমাকে নিজেদের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। মামী খুব স্নেহ করতেন। ঠিক হলো পরের দিনই কাপড় চোপড় নিয়ে চলে আসব। এখান থেকে কলেজ দেড় কিলোমিটার তাই একখানা সাইকেল কিনলেই ভালো হয়। এরপর শফিকদা বুলেটে বসিয়ে আমাকে কলেজে ছেড়ে দিলেন।
আজ কলেজে কোনো কাজ নেই। আগামী সপ্তাহ থেকে আমাদের ক্লাস শুরু হবে। এখন বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি চলছে। কেন্টিনে গেলাম। ওখানেও কেউ নেই। রেডিওতে গান চলছে। খালিদ হাসান মিলুর সেই বিখ্যাত গান -
'সেই মেয়েটি, আমাকে ভালোবাসে কিনা আমি জানিনা,
যার মেঘকালো চুল, হরিণীর চোখ, কন্ঠটি গানের বীণা....'
যার মেঘকালো চুল, হরিণীর চোখ, কন্ঠটি গানের বীণা....'
গান শুনলেই আজকাল অন্যমনস্ক হয়ে যাই। অনেক্ষন বসে রইলাম। একসময় দেখলাম মাঠ পেরিয়ে একা একা অলোক আসছে কেন্টিনের দিকে। এই অলোক কেন জানি আমাকে পছন্দ করে না। আজ ওকে কারণ জিজ্ঞেস করব।
অলোক এসে চা আর বিস্কুটের অর্ডার দিল। আমাকে দেখতে পায়নি। কেন্টিনের বাইরে বিছিয়ে রাখা বেঞ্চে ও বসে আছে। আমি গিয়ে ওর পাশে বসলাম। সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করলাম,
"অলোক, তুই আমাকে দেখলেই রেগে উঠিস কেন?"
ও বলল:
-- তুই মৌসুমীর সাথে এত দোস্তি ছেড়ে দে। বাইরে থেকে এসেছিস। পড়াশোনায় মন দে। ঐ মেয়েটি ভালো নয়!
শুনেই আগুন লেগে গেছে আমার মাথায়।
-- তাতে তোর কি হলো? আর ও যদি আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় তোর অসুবিধা কি? ও খারাপ কি না তা আমার উপর ছেড়ে দে।
অলোক বোঝতে পেরেছে যে আমি রেগে গেছি। শান্ত গলায় আমাকে বললো -
--আমার এক বন্ধু ওকে ভালোবাসে। তুই এসব থেকে দুরে থাক।
-- সেটা মৌসুমীকে জিজ্ঞেস করলেই হলো। ও ডিসাইড করুক। আমি এসব ভালোবাসা-টাসা কি জানি না ভাই। তবে মৌসুমী আর আমি হয়তো ভালো বন্ধু। এতে তোর আর তোর বন্ধুর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
"অলোক, তুই আমাকে দেখলেই রেগে উঠিস কেন?"
ও বলল:
-- তুই মৌসুমীর সাথে এত দোস্তি ছেড়ে দে। বাইরে থেকে এসেছিস। পড়াশোনায় মন দে। ঐ মেয়েটি ভালো নয়!
শুনেই আগুন লেগে গেছে আমার মাথায়।
-- তাতে তোর কি হলো? আর ও যদি আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় তোর অসুবিধা কি? ও খারাপ কি না তা আমার উপর ছেড়ে দে।
অলোক বোঝতে পেরেছে যে আমি রেগে গেছি। শান্ত গলায় আমাকে বললো -
--আমার এক বন্ধু ওকে ভালোবাসে। তুই এসব থেকে দুরে থাক।
-- সেটা মৌসুমীকে জিজ্ঞেস করলেই হলো। ও ডিসাইড করুক। আমি এসব ভালোবাসা-টাসা কি জানি না ভাই। তবে মৌসুমী আর আমি হয়তো ভালো বন্ধু। এতে তোর আর তোর বন্ধুর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
অলোক তর্কের খাতিরে চুপ হয়ে গেল। ওকে হতাশ দেখাচ্ছিল। কেন জানি ওর প্রতি একটু মায়া হলো। আমি অনেক উচ্চস্বরে ওর সাথে কথা বললাম কিন্তু ও যথেষ্ট শান্তভাবে কথা বলছে। চাইলে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে পারত। মারামারি হলেও আমি হেরে যেতাম। এছাড়াও ও একটা লোকেল ছেলে। ওকে সাপোর্ট করার জন্য যথেষ্ট সঙ্গি সাথি থাকবে। কিন্তু আমাকে তো কেউ চেনে না। অলোককে স্যরি বলে চলে এলাম। ভয় পেয়ে নয়, আসলে আমিই কর্কশ গলায় ওর সাথে কথা বলেছি। জিজ্ঞেস করলাম ওর বন্ধুর নাম, যে মৌসুমীকে ভালোবাসে। জুবায়ের মজুমদার। ফিলোসফি অনার্সের ছাত্র। চরগোলা থেকে আসে। ওরা সব একসাথে এই কলেজেই হায়ার সেকেন্ডারি পড়েছে। নিশ্চয়ই আগে থেকে পরিচয়। জানি না যা শুনলাম তা কতটুকু সত্য। মৌসুমীকে জিজ্ঞেস করা দরকার।
কেন্টিন থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরীতে এলাম। হয়তো এখানেই বসে আছেন ম্যাডাম। ঠিক তাই। চার পাঁচটা মেয়ে একসাথে বসে উচ্চস্বরে কথা বলছে। রোজকার মতন আজও সাদা চুড়িদার সালোয়ার পরে ও বসে আছে। সবাই কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে আর মৌসুমী বসে আছে। ভাবখানা যেন উনি দুনিয়ার সবচেয়ে জ্ঞানী। তাই চুপচাপ শুনছেন। দেখলেই মনে হয় মাথার ভেতর ওর অজস্র চিন্তা চলছে। ভুরু কুঁচকেই থাকবে। দুর থেকে ডাকলাম। দৌড়ে এলো যেন কয়েক বছর পর আমাদের দেখা হচ্ছে। ভুলে গেছে ওর ব্যাগ। ঘুরে গিয়ে নিয়ে এলো। বাকি মেয়েরা ওর তাড়াহুড়ো দেখে হাসতে লাগলো। আমারও হাঁসি উঠলো। দুজনে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে এলাম। কোথায় বসে কথা বলা যায় ভাবতে লাগলাম। অনেক কিছু বলার আছে। অনেক কিছু জানার আছে।
শেষমেষ বুদ্ধিটা ওর মাথায় এলো। চলে গেলাম বাশ আর টিন দিয়ে বানানো অস্থায়ী মেজরের ক্লাসরুমে। ক্লাসতো এখন তালা মারা থাকবে। কিন্তু ক্লাসের সামনের ঘাসে ঢাকা মাঠে বসব। গাছের তলায় ছায়া আছে। আজ বৃষ্টি নেই।
আজ যেন আমার আর কিচ্ছু বলার অধিকার নেই। ও থামতেই চায়না। ঘরের কথা, মা বাবার কথা এমনকি ওর আত্মীয় স্বজনদের কথা যেন শেষ হবে না। আমি ওর সামনেই ওর ব্যাগে মাথা দিয়ে ঘাসে শুয়ে আছি আর ও বলে যাচ্ছে ওর ছোটবেলার কথা। কিছু বলতে চাইলেই আমার মুখে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দেবে।
মা বাবা আর দুই বোন নিয়ে মোট চারজনের সংসার। বাবা ডায়াবেটিসের রোগী। পাঁচগ্রামে ওরা পেপার মিলের কোয়ার্টারে থাকে। ওর ছোট একটি বোন ক্লাস সিক্সে পড়ে নবোদয় বিদ্যালয়ে। দু'বছর পর বাবা রিটায়ার্ড হয়ে যাবেন। এর পর শুরু হলো ওর কি পছন্দ অপছন্দ এসবের কথা। অন্য কেউ হলে আমি এতক্ষনে বিরক্ত হয়ে চলে যেতাম। কিন্তু ওর কথাতো বিরক্তিকর মনে হচ্ছে না। যেন ও বলে থাকুক, আমি শুনে থাকি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল চারটা হয়ে গেছে আমাদের খেয়াল নেই। তবুও ওর কথা শেষ হয়না।
কি আশ্চর্য। মাত্র তিন চার দিন আমাদের পরিচয়। আমাকে ও এতো আপন ভাবছে যে পরিবারের সব কথা বলছে। যেন আমরা কতদিনের পরিচিত অথচ আজই আমি ওর কথা জানলাম ভালো করে। আমার বিষয়ে ও এখনও কিচ্ছু জানে না। খালি আমার নাম আর বাড়ি কোথায় সেটাই জানে।
জিজ্ঞেস করলাম: আমার বিষয়ে জানতে চাও না? বললো "আজ দেরি হয়ে গেছে। আমাকে বাসে তুলে দিয়ে বাড়ি যাও। কাল তাড়াতাড়ি চলে এসো।" আমি ভুলে গেলাম জুবায়েরের কথা জিজ্ঞেস করতে। ওকে বাসে তুলে দিলাম।
জিজ্ঞেস করলাম: আমার বিষয়ে জানতে চাও না? বললো "আজ দেরি হয়ে গেছে। আমাকে বাসে তুলে দিয়ে বাড়ি যাও। কাল তাড়াতাড়ি চলে এসো।" আমি ভুলে গেলাম জুবায়েরের কথা জিজ্ঞেস করতে। ওকে বাসে তুলে দিলাম।
এরপর যখন করিমগঞ্জগামি বাসের জন্য অপেক্ষা করছি তখন অকস্মাৎ দেখি আমার সামনে একেবারে গা ঘেঁষে সাত আটজন ছেলে দাড়িয়ে আছে। যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে একসাথে। সবার পেছনে অলোক। ওর সাথে আরেকটি ছিপছিপে ছেলে। সম্ভবত জুবায়ের হবে। ওরা নিশ্চয়ই আমাকে অনেক্ষন থেকে অনুসরণ করছিল। সঙ্গে সঙ্গে বোঝতে পারলাম এরা একসাথে মিলে নিশ্চয়ই আমাকে মারধর করতে এসেছে। কলেজে এডমিশান নেয়ার এক সপ্তাহ হয়নি আর আজই মার খেতে হবে! সঙ্গে সঙ্গে দৌড়তে শুরু করে দিলাম। এদের খপ্পর থেকে পালিয়ে না বাঁচলে আজ বিপদ আছে। উপরওয়ালার নাম নিয়ে গায়ের সব শক্তি এক করে দৌড়তে থাকলাম। থানার সামনের বাসস্ট্যান্ড থেকে উল্টোদিকে কলেজের উদ্দেশ্য দৌড়ে যাচ্ছি। রাস্তায় লোকজন দেখছেন। আগে আগে আমি দৌড়ে যাচ্ছি আর পেছনে সাত আটজন ছেলে দৌড়ে আমাকে ধরতে চাইছে। একদৌড়ে শ্রীমা টিস্টল। একেবারে ভেতরে চলে গেলাম আর খালি চেয়ার পেয়ে ধপাস করে বসে পড়লাম। ওরাও পিছু পিছু দৌড়ে এসে শ্রীমা টিস্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো।
শেষপর্যন্ত সব যাত্রিই নেমে গেলেন ফ্লাইট থেকে। সবার শেষে আমিও নামলাম। বাইরে বেরোতেই বিচ্ছিরি গরম লু হাওয়া গা ছুয়ে গেল। যেন মরুভূমিতে স্বাগত জানানো হলো।
দুবাই আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট অন্য দশটা পাঁচটা এয়ারপোর্ট থেকে সম্পুর্ন আলাদা। সম্ভবত সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর এটাই। বিশ্বের যেকোনো দেশে বা শহরে যেতে হলে দুবাই থেকে ডাইরেক্ট বা কানেক্টিং ফ্লাইট পেয়ে যাবেন। দিন রাত লক্ষ লক্ষ যাত্রি এখানে অবতরণ করেন। কেউ সংযুক্ত আরব আমিরাতের রেসিডেন্ট, কেউ নিছক বেড়াতে এসেছেন আর কেউ নিয়মমাফিক লে-অভারের সময় কাটাচ্ছেন যাদের গন্তব্য অন্য কোথাও। যারা দুবাইয়ে থাকবেন বা ঘুরতে এসেছেন তাদেরকে বাইরে এসে ইমিগ্রেশন এরিয়ায় যাওয়ার জন্য মেট্রো ট্রেনে বসতে হবে। সবার আগে ইমিগ্রেশন হবে। এরপর ব্যাগেজ বেল্ট। যারা এখানকার নাগরিক বা আমার মতো চাকরি করেন তাদের সবার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে এমিরেটস আইডি থাকে। এই আইডি একটি স্মার্টকার্ডের মতো যাতে এখানে বসবাসকারীর সব তথ্য ফীড করা থাকে। এই কার্ড নিয়ে সোজা চলে যেতে হবে স্মার্টগেটে। মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডে বায়োমেট্রিক গেট দিয়ে পার হয়ে গেলেই হলো। পাসপোর্টে ম্যানুয়েল স্টাম্প করাতে বা রেটিনা, ফিঙ্গার প্রিন্ট ভেরিফাই করতে হয়না। আর যারা স্বল্প মেয়াদী ভিসা নিয়ে এসেছেন তাদেরকে পুরনো পদ্ধতিতেই ইমিগ্রেশন করিয়ে নিতে হয়। সময় লাগে অনেক বেশি।
মেট্রো থেকে নেমে আমার আর মৌসুমী রায়ের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল। পৃথিবী গোল আর দুবাই এত বড়ো নয়। নিশ্চয়ই ওনার সাথে আবার দেখা হবে। বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন। পাচ মিনিটের মধ্যেই আমিও ব্যাগ নিয়ে বাইরে এলাম। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে টেক্সি করে নিলাম। এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে আল-নাহদা (আরবি শব্দ যার অর্থ রেনেসাঁ বা নবজাগরণ) নামক জায়গায় যেতে হবে। ওখানেই আমার কোম্পানি প্রদত্ত ফ্ল্যাট আছে। এত ভোরে ট্রাফিক নেই বললেই চলে। পেছনের সিটে বসে চোখ মুদলাম।
এবার বাড়ি থেকে ফেরার পথে কেন জানি পুরনো কথা মন থেকে যেতেই চাইছে না। ভাবছিলাম বদরপুর কলেজের ভর্তির সময়ের কথা। মৌসুমীর সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে জুবায়েরের সাথে ঝগড়ার কথা। আমি আর মৌসুমী শুরুতেই খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম যেটা জুবায়ের ভালো চোখে দেখেনি। আমিতো জানতামই না ওদের কি কোনো রিলেসন আছে না নেই। তখনকার দিনে ফেইসবুক হোয়াটসঅ্যাপ কিছুই ছিল না নইলে প্রফাইল ঘাটাঘাটি করে অন্তত অনুমান করা যেতো।
একদিন মৌসুমীকে বাসে উঠিয়ে দেয়ার পরই দেখি জুবায়ের আর তার বন্ধু অলোক কয়েকটা বখাটে ছেলে নিয়ে আমাকে মারধর করার জন্য রাস্তা আটকে ফেলে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি কোনোমতে দৌড়ে গিয়ে শ্রীমা টি স্টলে ঢুকলাম। ওরাও পিছু পিছু দৌড়ে এলো। টি স্টলের বাইরে অপেক্ষা করছিল যাতে আমি বাইরে বেরুলেই আক্রমণ করতে পারে।
শ্রীমা টি স্টলে বসে ভাবছিলাম এবার কি করা যায়। হঠাৎ সামনের দিক তাকিয়ে আমার প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। দেখি রেজাউল। ফিলোসফি মেজরের রেজাউল। সঙ্গে আরও তিন জন লোক নিয়ে কথা বলতে বলতে টি স্টলে ঢুকছে। দৌড়ে ওর কাছে গেলাম। ও আমাকে দেখে চমকে উঠল। সব খুলে বললাম। তখনও জুবায়ের বাহিনী বাইরে দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করছে। রেজাউল রাজনীতি করা সাহসী ছেলে। নিশ্চয়ই মারামারি হতে দেবে না। ও আমাকে টি স্টলে বসিয়ে রেখে ওদের সাথে কথা বলতে বাইরে বেরিয়ে গেলো। ভেতর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ওদের আলোচনা কথা কাটাকাটির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অনেকক্ষণ পর রেজাউল ভেতরে এলো। ওরা চলে গেছে। ও বলল আগামীকাল এনিয়ে কলেজে আলোচনা হবে। মৌসুমী যা বলবে তাই ফাইনাল। এর পর ও আমাকে বাসস্ট্যান্ডে ছেড়ে দিয়ে এলো। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বাসে বসে ভাবছিলাম আজ রেজাউল না হলে হয়তো খুব মার খেতে হতো।
পরের দিন কলেজে এসেই দেখি গেটের সামনেই মৌসুমী দাঁড়িয়ে আছে। কেন্টিনে গিয়ে বসলাম আর গতকালের ঘটনা খুলে বললাম। এত সিরিয়াস ঘটনা শুনে ও হাসতে লাগলো। ওর হাসি থামবেই না। এবার আমার রাগ হচ্ছিল। উঠে আসতে চাইলাম। ও টেনে বসাতে চাইল। কিন্তু শক্তি দিয়ে পারছিল না। না পেরে পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো - "তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু। জুবায়েরও একসময় আমার ভালো বন্ধু ছিল কিন্তু ও আমার সাথে প্রেম করতে চায় যেটা আমার ভালো লাগে নি। হায়ার সেকেন্ডারি ফাইনালের আগে থেকেই আমাদের কথা বলাবলি নেই।" এই বলে আমার দিকে ও তাকালো।
-- তে আমিও কি তোমার বন্ধু?
-- খুব ভালো বন্ধু।
-- বন্ধু হলেও তুমি একজন মেয়ে। ঘন্টার পর ঘন্টা এরকম কথা বলা, ফস করে হাতে টেনে নেয়া, আর হাত ধরে বসে থাকা বা এইযে তুমি জড়িয়ে ধরলে এসবের মানে কি? ছেলে আর মেয়ে বন্ধু হলে দুরত্ব বজায় রাখা দরকার।
-- ওসব আমি জানি না। আর মানি না।
-- মানে?
-- জানি না।
-- তার মানে আমরা বন্ধুর থেকে আরেকটু বেশি?
-- জানি না।
এবার রাগ উঠছিল। বললাম:
-- আমি তা হলে যাচ্ছি। কাল ভাড়াঘরে এসে যাবো। আর যখন ক্লাস শুরু হবে তখনই কলেজে আসব। আগামী সপ্তাহ থেকে।
-- তোমার ইচ্ছে। আমি কি করবো?
-- কিচ্ছু করতে হবে না। খালি বললাম।
-- আমি কি জিজ্ঞেস করেছি?
-- তে আমিও কি তোমার বন্ধু?
-- খুব ভালো বন্ধু।
-- বন্ধু হলেও তুমি একজন মেয়ে। ঘন্টার পর ঘন্টা এরকম কথা বলা, ফস করে হাতে টেনে নেয়া, আর হাত ধরে বসে থাকা বা এইযে তুমি জড়িয়ে ধরলে এসবের মানে কি? ছেলে আর মেয়ে বন্ধু হলে দুরত্ব বজায় রাখা দরকার।
-- ওসব আমি জানি না। আর মানি না।
-- মানে?
-- জানি না।
-- তার মানে আমরা বন্ধুর থেকে আরেকটু বেশি?
-- জানি না।
এবার রাগ উঠছিল। বললাম:
-- আমি তা হলে যাচ্ছি। কাল ভাড়াঘরে এসে যাবো। আর যখন ক্লাস শুরু হবে তখনই কলেজে আসব। আগামী সপ্তাহ থেকে।
-- তোমার ইচ্ছে। আমি কি করবো?
-- কিচ্ছু করতে হবে না। খালি বললাম।
-- আমি কি জিজ্ঞেস করেছি?
ততক্ষনে রাগে আমি অন্ধ হয়ে গেছি। মেয়ে না হলে হয়তো ধাক্কা মেরে ফেলে দিতাম। বোঝলাম না ও কেন এভাবে কথা বলছে? আমার দোষ কি? আমরা কেমন বন্ধু তা জানার দরকার ছিল। কিন্তু এধরনের উত্তর দেয়ায় আমার খুব রাগ উঠছে। রাগের থেকেও বেশি দূঃখ। মৌসুমী অন্যদিকে ফিরে বসে আছে। আমি চলে আসার জন্য উঠলাম। একটু দাঁড়ালাম হয়তো ও বসতে বলবে। কিন্তু ও কিচ্ছু বললো না। আমিও চলে এলাম। এবার আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। কেউ এমনভাবে কথা বললেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। লাইব্রেরীতে গিয়ে বসে রইলাম।
প্রায় আধাঘণ্টা পর রেজাউল এসে আমাকে খুঁজে বের করলো। জুবায়ের আর মৌসুমীর বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করতে হবে যাতে গতকালের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা যায়। রেজাউল বড় ভালো মনের ছেলে। সব কলেজে এমন কিছু ছেলে থাকে যারা কলেজ কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই ছোটোখাটো সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল মৌসুমী কোথায়। বললাম - জানি না। ও আমাকে আর জুবায়েরকে বসিয়ে 'ওকে নিয়ে আসছি' বলে চলে গেল। আমি আর জুবায়ের বসে রইলাম। কোনো কথাবার্তা নেই। আমার খুব রাগ উঠছিল।
কিছুক্ষণ পর রেজাউল এলো। তবে একা। এসে বললো, মৌসুমী বলেছে ওর নাকি আমাদের কারুর সাথেই কোনো সম্পর্ক নেই। শুধুই ক্লাসমেট। জুবায়ের এই কথা শুনে হেসে উঠলো। এই হাঁসি আনন্দের না দূঃখের বোঝলাম না। রেজাউলের কথা রাখতে আমি আর জুবায়ের হাত মেলালাম। ওরা চলে গেলো। আমি বসে রইলাম। লাইব্রেরীর টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে বসেছিলাম। চোখ দিয়ে জল বের হচ্ছিল। ভালোবাসা ছিল না সম্ভবত তবে ব্রেকআপ ঠিকই হয়েছে। খুব বেশি রাগ উঠলে আমার মাথা ধরে। শরীর খারাপ লাগছিল। ভাবলাম বাড়ি চলে যাই কিন্তু এত বেশি মাথাব্যথা, হয়তো রাস্তায় পড়ে যেতে পারি। তাই বসে রইলাম। লাইব্রেরীতেই চেয়ারে বসে মাথা টেবিলে রেখে ভাবছিলাম এই চ্যাপ্টার কি শেষ হলো না আরও বাকি আছে। কখন যে ঘুম এসে গেলো জানি না।
পরের সপ্তাহ থেকে মেজরের ক্লাস শুরু হলো। এরমধ্যে আমি বদরপুরের রুপসীবাড়ির নতুন পেয়িং গেস্ট ঘরে এসে গেছি। বদরপুরে অনেক ঘোরাঘুরি করেছি এই কদিন। বিরক্তিকর সময় কাটতেই চায় না। যেন ক্লাস শুরু হলেই বাঁচি। মাঝখানে একদিন কলেজে গিয়ে রুটিন নিয়ে এলাম। কারুর সঙ্গে দেখা হলো না। রুটিন অনুযায়ী রোজ মেজরের চারটে করে ক্লাস আর তিনটে পাস কোর্সের সাবজেক্ট। সকাল নয়টা থেকে শুরু করে চারটে অবধি। শনিবার দুটো মেজর আর আর পাসকোর্স এর ক্লাস চলবে ২.৩০টা পর্যন্ত।
একখানা নতুন হারকিউলিস সাইকেল কিনে আনলাম। এরপর ঘরে থাকতামই না। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেতাম। রেল কলোনি, জুম বস্তি, বদরপুর ঘাট, কাটিগড়া চৌরঙ্গী এমনকি শ্রীগৌরি বা মালুয়ায় গিয়ে কোথাও না কোথাও বসে থাকতাম। শ্রীগৌরি আর বদরপুর ঘাটের দুটি জায়গা খুব প্রিয় ছিল। বরাক নদীর পারে জনমানবহীন দুটি স্থান। একটি শ্রীগৌরি বাজারের পেছনে একটি বড় গাছের আড়ালে। সম্ভবত জামরুল গাছ। আরেক জায়গা বদরপুর ঘাটের ঐতিহাসিক কেলার পেছনে। এদুটো জায়গা এমন ছিল, যখন নদী ভরা থাকবে তখন জল পা ছুঁয়ে যাবে। তীরে বসে হাত দিয়ে জল ছোঁয়া যাবে। দুটো জায়গায় জনসমাগম নেই বললেই চলে। আমি প্রায় রোজ গিয়ে বসে থাকতাম সন্ধ্যা মিলিয়ে অন্ধকার হওয়া অবধি। আজ যদি শ্রীগৌরি বাজারে যাই তবে কাল বদরপুর ঘাটে। সামনে কলকলিয়ে চলছে বরাক নদী। আমি যে বরাক নদীর পাশে বসে থাকতাম তা ছবির মতো নীল আর শান্ত নয়। বরং ঘোলা, বদমেজাজি অধৈর্য শ্রোতস্বিনি। কাউকে পরোয়া করবে না। যত রাজ্যের কচুরিপানা, আবর্জনা, বাঁশ, গাছের গুঁড়ি নিয়ে যাবে। একের পর এক যেন লাইন ধরে চলে যাচ্ছে যেন এ এক মৌন মিছিল চলছে। এ যেন নদীর এক অনেক বড়ো দায়িত্ব। কখনও আবর্জনার স্তূপ বা গাছের ডাল পারে কোথাও আটকে যাবে। কিন্তু অধৈর্য স্রোত ধাক্কা দিতে থাকবে যতক্ষণ না ঐ জঞ্জাল ছুটিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কখনও জল কমে যাবে। স্রোতও নেই। যেন কয়েকদিনের বিশ্রাম। আবার একদিন সেই আগের উদ্দাম বীরপুরুষের মতো যাত্রা। বেপরোয়া, বাধাহীন অশান্ত বরাক। সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় হলেই আকাশ, নদী আর পারিপার্শ্বিকতা মিলেমিশে এক অদ্ভুত রং ফুটে উঠবে। সে এক মায়াবি সময়। ওপারে লোকালয়ে জ্বলে উঠা বাতি এক মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি। সূন্দর কিন্তু করুণ। জানতাম একসময় সব অন্ধকার হয়ে যাবে। বরাক লুকিয়ে যাবে রাতের অন্ধকারে। অদৃশ্য ঝাপসা নদী। আমার একাকীত্বের নীরব স্বাক্ষী। আমাকে এখন ঘরে ফিরতে হবে।
যথারীতি পরের সপ্তাহে ক্লাস শুরু হলো। প্রথম দিন থেকেই আমি হুসেইন স্যারের প্রিয় পাত্র হয়ে গেলাম। বিশজন ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে প্রথম দিনই তিনটে স্টাডি গ্রুপ বানিয়ে দেয়া হলো। আমি, রাজু, কবিতা, অমর, সুলতানা আর মঞ্জুশ্রী নিয়ে ছয়জনের গ্রুপ। মৌসুমী গ্রুপ সি তে পড়েছে। এখন থেকে তিনটি স্টাডি গ্রুপের মধ্যে ইন্টারনেল কম্পিটিশন থাকবে। প্রথম দিন একের পর এক ক্লাস। কারুর সাথে কথা হলো না। একবার মৌসুমীকে দেখলাম। আমার দিকে চেয়ে আছে। কিছুটা নিস্তেজ, নিরস না আমার দেখার ভূল? চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ওকে দেখলেই কিছু সময়ের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে যাই। কিন্তু এমন হলে চলবে না। আই হ্যাভ টু মুভ অন!
কয়েকদিন এভাবে চললো। তবে কলেজে এলেই চুপচাপ খুঁজতে থাকতাম মৌসুমীকে। আমি নই যেন আমার সুপ্ত ভেতরের আমি ওকে খুঁজে চলছে। যেন একবার দেখলেই আপাত দায়িত্ব শেষ। এরপর কথা বার্তা নাই হোক। তবে ও থাকুক চোখের সামনে। রোজ যেন আসে ও। একবার দেখলেই আমার নিস্তেজ নিরস ইচ্ছে আবার পড়াশোনায় লেগে যাবে। কিন্তু সমস্যা কাটছে না। তিন চারদিন পর অসহ্য লাগা শুরু হয়ে গেল। সবকিছু বিরক্তিকর। ক্লাসের ফাঁকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম। কলেজ বিল্ডিংয়ের পেছনে, লাইব্রেরীর একেবারে কোনার বেঞ্চে নইলে কেন্টিনের বাইরে একেবারে পশ্চিম দিকে যেখানে সচরাচর কেউ যায় না বা বসে না সেখানে বসে থাকতাম। ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনও ইচ্ছে হতো আজ ওর সাথে যেমন করেই হোক কথা বলব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিন শেষ হয়ে যেত। সুযোগ হয়ে উঠতো না। এমনিতে আমি অন্য কারুর সঙ্গে মিশতাম না। একা একা কলেজে আসতাম। ক্লাস শেষ হলে চলে যেতাম। পড়াশোনা খুব একটা হচ্ছিল না। হুসেইন স্যারের বকুনি খাওয়া রোজকার ঘটনা হয়ে যাচ্ছিল।
নতুন পিজিতে আমার নতুন মামা মামী খুব স্নেহ করতেন। খেয়াল রাখতেন। আমি কলেজ থেকে এলেই যে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাই আর অনেক দেরি করে ফিরি তা ওদের চোখ এড়ালো না। ওরা হয়তো ভাবতেন আমি বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিতে ভালোবাসি কিন্তু আমি যে ভেতরে ভেতরে মন খারাপের রোগে আক্রান্ত তা জানতেন না। তবে আমাকে প্রাইভেসি দিতেন। আগে থেকে না বললে কিছুই জানতে চাইতেন না।
কয়েকদিন পর কেন জানি অসুস্থ হয়ে গেলাম। সন্ধ্যা হলেই জ্বর হয়। প্রথমে সাধারণ ঠান্ডা লেগে হওয়া জ্বর ভেবেছিলাম। পেরাসিটামল খেলে কমে যেত। কিন্তু পরে কেঁপে কেঁপে জ্বর উঠা শুরু হলো। দিন রাত সবসময় শরীর গরম। দুর্বল হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে বমি হতো। পেটব্যাথা লেগেই থাকতো।
মামা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার জানালো জন্ডিস হয়ে গেছে। বেশি হওয়ায় কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মামা কলেজে গিয়ে অসুখের কথা জানিয়ে এলেন। গ্রামের বাড়ি থেকে মা এলেন। আমাকে নিয়ে যেতে চাইলেন কিন্তু আমি গেলাম না।
মামা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার জানালো জন্ডিস হয়ে গেছে। বেশি হওয়ায় কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মামা কলেজে গিয়ে অসুখের কথা জানিয়ে এলেন। গ্রামের বাড়ি থেকে মা এলেন। আমাকে নিয়ে যেতে চাইলেন কিন্তু আমি গেলাম না।
একদিন দুপুর বেলা শুয়ে আছি। ঘুম আসছে না। অনেকদিন বাইরে যাওয়া হয়নি। ভাবছিলাম সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাই। কিন্তু শরীর দুর্বল থাকায় সাহস হচ্ছিল না। গুনে দেখি দশ দিন হয়ে গেছে কলেজে যাইনি। পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। মিড-টার্ম পরীক্ষা ভালো হবে না। চোখ লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। অনেক সময় থেকে কেউ জোরে দরজায় কড়া নাড়িয়ে যাচ্ছে। উঠে খুলে দিলাম। দেখি মামী দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে বললেন কলেজ থেকে দুটো মেয়ে দেখা করতে এসেছে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মৌসুমী আর সুলতানা। সেই সাদা চুড়িদার সালোয়ার। জাসমিনের পরিচিত গন্ধ নাকে লাগলো। সত্যিই মৌসুমী না আমি স্বপ্ন দেখছি?
এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এতদিন আমি জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকতাম। এখন কি তবে হেলুসিনেশন শুরু হলো? বাস্তব কখনও স্বপ্নের মতো অসম্ভব হয়, আবার স্বপ্ন কখনো বাস্তবের মতো সত্য মনে হয়।
বারবার কড়া নাড়ছে কেউ। আমি চোখ খুলতে পারছিনা। কোনোমতে শরীরটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে দরজা খুলেই ভিরমি খাবার উপক্রম। বলা নেই কওয়া নেই একেবারে স্বশরীরে উপস্থিত মৌসুমী তাপাদার! সবচেয়ে আশ্চর্য আমি যে এই বাড়িতে থাকি ম্যাডাম কিভাবে জানলেন? এসব ভাবতে ভাবতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরে বৃষ্টি হওয়ার শব্দ কানে আসছে অথচ ওদের গায়ে একফোঁটাও জল নেই। ভেতরে এসেই শুরু হয়ে গেল মৌসুমী!
-- কতদিন থেকে স্নান করো নি?
-- কালকেই গরম পানিতে টাওয়েল ভিজিয়ে মুছে নিয়েছিলাম। এর আগের দিন মাথায় জল ঢেলে শ্যাম্পু করেছি।
-- তোমাকে নোংরা দেখাচ্ছে। খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছ বুঝি?
--- (আমি চুপ)
-- কোন ডাক্তার দেখালে? আমাদের পাঁচগ্রামে একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার আছেন, সেখানে গেলে ফট করে ভালো হয়ে যেতে।
-- না, ঠিক আছে। এখন অনেকটা সুস্থ।
-- কালকেই গরম পানিতে টাওয়েল ভিজিয়ে মুছে নিয়েছিলাম। এর আগের দিন মাথায় জল ঢেলে শ্যাম্পু করেছি।
-- তোমাকে নোংরা দেখাচ্ছে। খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছ বুঝি?
--- (আমি চুপ)
-- কোন ডাক্তার দেখালে? আমাদের পাঁচগ্রামে একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার আছেন, সেখানে গেলে ফট করে ভালো হয়ে যেতে।
-- না, ঠিক আছে। এখন অনেকটা সুস্থ।
মামী চা বিস্কুট নিয়ে এলেন। আমার টেবিলের উপরের বইয়ের পাহাড় সরিয়ে কোনোমতে চায়ের ট্রে রাখার জায়গা হলো। মামি চলে গেলেন। আমি জগ উঁচু করে জল খেলাম। আমার ঘরে একটিই চেয়ার। বিছানার কোনায় সুলতানা বসে আছে আর চেয়ারে মৌসুমী। আমি জানালা খুলে দিলাম। এক মুঠো হাওয়ার অনধিকার প্রবেশ। জানালার বাইরেটা দেখা যাচ্ছে না কেন? বৃষ্টি নেই এখন।
চা খাওয়ার পর সুলতানা বলল পান সুপারি চাই। মৌসুমী বলে উঠল, 'চুপ, আমরা রোগি দেখতে এসেছি'। আমি বিছানায় বসে আছি। কয়েক মিনিট কথা বার্তা নেই। সুলতানা গান ধরলো -
'দাড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে,
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমারে'...
'দাড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে,
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমারে'...
কি সুন্দর গলা। আমি আর মৌসুমী ওর দিকে অপলক চেয়ে আছি। ও জানালার বাইরের দিকে চেয়ে গেয়ে যাচ্ছে। আমার বিছানা থেকে সুলতানা অনেক দূরে। মাঝে মাঝে ওর ছবি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে আবার কখনো ওকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গানের সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আমার কোঠার এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়ালে আছড়ে পড়ে আবার ফিরে আসছে সুলতানার সুললিত সুর।
সুলতানা বোঝতে পারলো আমরা চুপচাপ ওর গান শুনছি। একটু লজ্জা পেল। আমরা অনুরোধ করলাম আরেকটি গান শোনাতে। কিন্তু না, হলো না। এরপর সুলতানা বাথরুম যাবে। মামীকে ডাকতে হলো। না মামী সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এতক্ষণ? নিয়ে গেলেন ওকে।
আমার কোঠায় আমি আর মৌসুমী একা। খানিকক্ষণ নিরবতার পর আবার কথা শুরু হলো।
-- এখনও জ্বর আছে?
-- সকাল থেকে কম।
ও উঠে এলো। আমার কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখছে। ঠান্ডা হাত। যেন কেউ মখমলের রুমাল রেখে দিয়েছি তপ্ত কপালে। এরপর হুট করে হাত সরিয়ে নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। যেন একটা ভুল হয়ে গেছে। আরেকটু সময় কপালে হাত রাখলে কি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খসে পড়তো?
-- এখনও জ্বর আছে?
-- সকাল থেকে কম।
ও উঠে এলো। আমার কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখছে। ঠান্ডা হাত। যেন কেউ মখমলের রুমাল রেখে দিয়েছি তপ্ত কপালে। এরপর হুট করে হাত সরিয়ে নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। যেন একটা ভুল হয়ে গেছে। আরেকটু সময় কপালে হাত রাখলে কি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খসে পড়তো?
-- কলেজ কবে থেকে যাচ্ছ?
-- একটু ভালো হয়ে যাই। আর কলেজে যেতে ইচ্ছে করে না।
-- কেন?
-- জানি না। তোমাকে দেখলে রাগ উঠে।
-- স্যরি।
-- কেন আমাকে এড়িয়ে চলছ আজকাল?
-- ( ও চুপ)
-- আমার কি কোনো ভুল হয়েছে?
-- না। আমার খুব ভয় হয়।
-- কেন? কিসের ভয়?
-- জানি না।
-- শোনো। আই থিঙ্ক আই লাভ ইউ!
-- একটু ভালো হয়ে যাই। আর কলেজে যেতে ইচ্ছে করে না।
-- কেন?
-- জানি না। তোমাকে দেখলে রাগ উঠে।
-- স্যরি।
-- কেন আমাকে এড়িয়ে চলছ আজকাল?
-- ( ও চুপ)
-- আমার কি কোনো ভুল হয়েছে?
-- না। আমার খুব ভয় হয়।
-- কেন? কিসের ভয়?
-- জানি না।
-- শোনো। আই থিঙ্ক আই লাভ ইউ!
সুলতানা এসে ঢুকলো। গুনগুনিয়ে যাচ্ছে এবার আরেকটি গান। এবারেরটা হিন্দি। "তেরে জেয়সা ইয়ার কাহা, কাহা এয়সা ইয়ারানা..." নিঃসন্দেহে সুলতানার গলা ভালো। আমি আর মৌসুমী চুপ। আমি চোখ তুলে তাকাতে পারছি না। সুলতানা বললো, 'গল্প শেষ হলে চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে'। ও কি জানত, গল্প কখনও শেষ হবে না! যেন মন চাইছে না তবুও মৌসুমীকে উঠে দাঁড়াতে হলো। এবার ওরা যাবে।
-- যাই?
-- (আমি চুপ)
-- সোমবার থেকে কলেজে এসো।
-- দেখি। আগে জ্বর কমুক।
-- কমে যাবে। আই নো।
-- যাই?
-- (আমি চুপ)
-- সোমবার থেকে কলেজে এসো।
-- দেখি। আগে জ্বর কমুক।
-- কমে যাবে। আই নো।
ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে এমন সময় মৌসুমী ঘুরে এলো। সুলতানার বুদ্ধি আছে। ও বেরিয়ে গেলো। মৌসুমী ঘুরে এসে কানের কাছে মুখ এনে বললো 'তুমি একটা পাগল', আই লাভ ইউ টু'। ওর মুখের গরম শ্বাস আমার কানে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি কেঁপে উঠলাম।
পৃথিবী কি ক্ষনিকের জন্য থেমে গেছে? জানালা দিয়ে ঘরে এসে সব কিছু উড়িয়ে দিচ্ছে এক বিদেশি বাতাস। দুলছে পর্দা। যেন এক গানের সূর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। এমন মনে হচ্ছে যেন মধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করছে না। আমি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি কিন্তু পা উঠানো যাচ্ছে না। আমার শরীরে যেন আর নিয়ন্ত্রণ নেই আমার। এসব কি সত্যি? না চিমটি কেটে দেখতে হবে আমি জেগে আছি না শুয়ে আছি? এত আলো সবদিকে কেনো? উজ্জ্বল প্রখর রোদ ঢুকে যাচ্ছে আমার শিরায় শিরায়। আমি যেন বাতাসের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। এক অভুতপূর্ব অনুভূতি। কেউ আমাকে নাম ধরে ডেকে চলেছে। যেন গুহার ভেতর থেকে শব্দ আসছে। চোখ খুলে দেখি আমি ঘেমে উঠেছি। দরজা বন্ধ। বাইরে সম্ভবত তুফান হচ্ছে। মামী তখনও ডেকে চলছেন। বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দিলাম। অবিশ্বাস্য স্বপ্ন অবশেষে ভেংগে গেল। মামীর হাতে চায়ের কাপ আর থিন এরারুট বিস্কুট।
আজ রোববার। আগামীকাল থেকে কলেজ যেতে হবে। পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। শরীর আজ অনেক হালকা লাগছে। জ্বর কমে গেছে। বাইরে কালবৈশাখীর ঝড়। ঠান্ডা বাতাস থেকে বাঁচতে জেকেট পরে নিয়ে বারান্দায় বসলাম। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে কিন্তু মামীকে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছে নেই। মুখে স্বাদ নেই তবুও চায়ে ভিজিয়ে বিস্কুট খেলাম। মৌসুমী এখন স্বপ্নে আসা শুরু করে দিয়েছে দেখছি। আমি তো ওকে নিয়ে ভাবি না। দিন রাত শুয়ে আছি এই কদিন। হয়তো আমার অবচেতন মনের ক্যানভাসে এক তৈলচিত্র আঁকা হয়ে গেছে। এরই প্রতিফলন এই সত্যের মতো স্বপ্ন? এত স্পষ্ট, পরিষ্কার যেন মৌসুমী আর সুলতানারা এক্ষুনি বেরিয়ে গেলো। ওদের কথাবার্তা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে এখনও কানে এসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আমার কোঠায় জাসমিনের সুগন্ধি পাওয়া যাবে এখনও হয়তো তবে ঠান্ডা লেগে সর্দি কাশি হয়ে আমার নাক বন্ধ। বুকভরে নিঃশ্বাস নিলাম। অদূরে হাইওয়ে দিয়ে হর্ন বাজিয়ে চলে যাচ্ছে ট্রাক। ঝড় থেমে গেছে কিন্তু বৃষ্টি থামছে না। খুব ঘুম পাচ্ছে। মামী কি না খেয়ে শুতে দেবে?
পরের দিনও একটু একটু জ্বর আছে। সোয়েটার পরে কলেজে গেলাম। শরীর ঠিক হয়নি কিন্তু আর কতদিন ঘরে বসে থাকবো! সাইকেল নেই নি। মেজরের ক্লাসে গিয়ে জানতে পারলাম, হুসেইন স্যারের বদলি হয়ে গেছে। উনি এখন হাফলঙ্গের একটি কলেজে ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে যোগ দেবেন। মেজরের সবাই ভাবছিল হুসেইন স্যারের কাছে টিউশন নেবে কিন্তু এখন তো আর হবে না। ব্রিটিশ ড্রামা পড়ান চৌধুরী স্যার। ঠিক হলো ওনার সাথে টিউশনের জন্য কথা বলতে হবে। কলেজের ক্লাসের উপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। সব পেপারেই আমাদের রেডিমেড নোট চাই। সুলতানা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি টিউশন নেবো কি না। রাজি হলাম। মাঝখানে একটি নন-মেজরের পিরিয়ড হলো না। কেন্টিনে গিয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি মৌসুমী আসছে। একা।
আমি কেন্টিনের বাইরে বেঞ্চে বসে আছি। মৌসুমীও এসে বললো।
-- কি খবর? শোনলাম শরীর খারাপ!
-- হু। জন্ডিস। মোটামুটি কমে গেছে।
-- তুমি কি আমাকে খারাপ পেয়ে বসে আছ?
-- তবে কি খারাপ পেয়ে দাড়িয়ে থাকতে হবে?
-- ফাজলামি হচ্ছে?
-- হ্যা।
-- বলো না।
-- কি?
-- সবসময় এড়িয়ে চলছো দেখি?
-- আমি এড়িয়ে চলছি? আই সি!
-- আসলে দোষটা আমার
-- ওকে। শুনলাম।
-- আমার খুব ভয় হয়।
-- ওকে। বলতে থাক।
-- জুবায়ের একটা গুন্ডা ছেলে।
-- (আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি)
-- তাই ভাবলাম তোমার আমার কোনো সম্পর্ক না রাখাই ভালো। এমনিতেও তুমি বাইরে থেকে এসেছো। ঝগড়াঝাঁটি হলে তোমার পড়াশোনা লাটে উঠবে।
-- ধন্যবাদ। আমার জন্য তোমার ভয়?
-- হুঁ।
-- তুমি কি আমায় ভালবাসো?
-- (ও চুপ)
-- কি হলো?
-- জানি না।
-- একটু তাড়াতাড়ি জেনে ফেললে ভালো হয়।
-- হুঁ
-- তুমি এতো অন্যমনস্ক কেন হয়ে যাও?
-- না না, শুনছি।
-- আমার দিকে দেখো।
-- (ও চুপ। মাথা নিচু করে আছে)
-- হ্যালো? এদিকে দেখো।
ওর চোখে জল। দুচোখ দিয়ে দুটি শুভ্র জলের বিন্দু গাল গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। স্কার্ফ দিয়ে চোখ মুছে বসে আছে। আমি ওর চিবুকে হাত দিয়ে মুখ উপরে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলাম:
-- তোমার কি কোনো অসুবিধা চলছে?
-- না। আমি ঠিক আছি।
-- তুমি কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছ!
-- না।
-- বলো।
-- আজ নয়। অন্য কোনো দিন।
-- কখন?
-- শনিবারের ক্লাস শেষ হয়ে গেলে কোথাও যাওয়া যাবে?
-- কোথায়?
-- তুমিই ঠিক করো। তুমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
-- আচ্ছা দেখি। বদরপুর ঘাটে একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্ট আছে। বসা যাবে।
-- ওকে, ঠিক আছে।
-- কি খবর? শোনলাম শরীর খারাপ!
-- হু। জন্ডিস। মোটামুটি কমে গেছে।
-- তুমি কি আমাকে খারাপ পেয়ে বসে আছ?
-- তবে কি খারাপ পেয়ে দাড়িয়ে থাকতে হবে?
-- ফাজলামি হচ্ছে?
-- হ্যা।
-- বলো না।
-- কি?
-- সবসময় এড়িয়ে চলছো দেখি?
-- আমি এড়িয়ে চলছি? আই সি!
-- আসলে দোষটা আমার
-- ওকে। শুনলাম।
-- আমার খুব ভয় হয়।
-- ওকে। বলতে থাক।
-- জুবায়ের একটা গুন্ডা ছেলে।
-- (আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি)
-- তাই ভাবলাম তোমার আমার কোনো সম্পর্ক না রাখাই ভালো। এমনিতেও তুমি বাইরে থেকে এসেছো। ঝগড়াঝাঁটি হলে তোমার পড়াশোনা লাটে উঠবে।
-- ধন্যবাদ। আমার জন্য তোমার ভয়?
-- হুঁ।
-- তুমি কি আমায় ভালবাসো?
-- (ও চুপ)
-- কি হলো?
-- জানি না।
-- একটু তাড়াতাড়ি জেনে ফেললে ভালো হয়।
-- হুঁ
-- তুমি এতো অন্যমনস্ক কেন হয়ে যাও?
-- না না, শুনছি।
-- আমার দিকে দেখো।
-- (ও চুপ। মাথা নিচু করে আছে)
-- হ্যালো? এদিকে দেখো।
ওর চোখে জল। দুচোখ দিয়ে দুটি শুভ্র জলের বিন্দু গাল গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। স্কার্ফ দিয়ে চোখ মুছে বসে আছে। আমি ওর চিবুকে হাত দিয়ে মুখ উপরে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলাম:
-- তোমার কি কোনো অসুবিধা চলছে?
-- না। আমি ঠিক আছি।
-- তুমি কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছ!
-- না।
-- বলো।
-- আজ নয়। অন্য কোনো দিন।
-- কখন?
-- শনিবারের ক্লাস শেষ হয়ে গেলে কোথাও যাওয়া যাবে?
-- কোথায়?
-- তুমিই ঠিক করো। তুমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
-- আচ্ছা দেখি। বদরপুর ঘাটে একটি ছোট্ট রেস্টুরেন্ট আছে। বসা যাবে।
-- ওকে, ঠিক আছে।
যেন আমাদের মধ্যে কিচ্ছু হয়নি। ঠিক আগের মতই আছি আমরা। কেন্টিন থেকে ক্লাসে চলে এলাম। ভাবছিলাম এমন কী সমস্যা হতে পারে ওর। কেউ কি যন্ত্রণা দিচ্ছে? না কোনো ঘরোয়া ব্যাপার? প্রথম দিন থেকেই আমাদের মধ্যে কিছু একটা গড়ে উঠেছে সেটা অস্বীকার করা যাবে না। জানি না আমার যতটুকু ওর কথা মনে পড়ে ওর কি সেরকম মনে পড়ে আমার কথা? কালকের স্বপ্নের কথা বলবো বলবো করে বলা হলো না। মেয়েটি হয়তো খুব সহজ সরল নইলে সাঙ্ঘাতিক চালাক। কিন্তু ওকে অবিশ্বাস করতে মন চায় না। শনিবার কি বলবে মৌসুমী? ওর পুরনো প্রেমের কথা? জুবায়েরের বিষয়ে না অন্য কিছু? শনিবার এলে জানা যাবে। মাঝখানে এখনও পাঁচ দিন।
আজ আমি সম্পুর্ন সুস্থ। যেন কোন এক অদৃশ্য ছোঁয়ায় আমার সব অসুখবিসুখ গায়েব হয়ে গেছে। আজ বাড়ি ফিরে পুকুরে নেমে স্নান করবো। মায়ের কথা মনে পড়ছে। বিকেল বেলা পিসিও থেকে ফোন করলাম। কয়েকদিন পর রোজার মাস শুরু হয়ে যাচ্ছে। ঈদের সময় আব্বা বাড়ি আসবেন। ছোটভাই চল্লিশ দিনের জন্য জামাতে গেছে। ওরা নাকি চেন্নাই যাচ্ছে এবার।
টেক্সির ব্রেকের কর্কশ আওয়াজ শুনে চোখ খুললাম। বোঝতেই পারিনি যে আমার গন্তব্যস্থল এসে গেছে। এয়ারপোর্ট থেকে এত কম সময়ের মধ্যে আমাদের বিল্ডিংয়ের পৌঁছে গেছি! ড্রাইভার ব্যাগ বের করে দেয়ার জন্য আগেই নেমে গেছে। আমিও নামলাম। কি সুন্দর সময়। শেষ রাত আর সকালের মাঝখানের মুহূর্ত। পূবের আকাশ লাল হওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে । টেক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। ৩৬.৫০ দিরহাম। বিশ দিরহামের দুটি নোট দেয়ার পর ড্রাইভার পকেটে হাত দিয়ে কয়েন খুঁজছিল সম্ভবত। ইশারা করে মানা করলাম।
ওয়াসিস এপার্টমেন্টের লবিতে আফগানি রিসেপশনিস্ট ছেলেটি টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে আছে। কোনো শব্দ না করে লিফটের বোতাম টিপে পৌঁছে গেলাম পাঁচ তলার ৫০৩ নম্বর ফ্ল্যাটে। তিন বেডরুম, হল আর কিচেন নিয়ে আমাদের ফ্ল্যাট। আমার রুমে গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন মসজিদে আজান হচ্ছে। জানালা খুলে দিলাম। নামাজের পর কয়েক ঘণ্টা ঘুমনো যাবে। এগারোটা অব্দি অফিসে পৌঁছলেও অসুবিধে নেই। বিছানায় বসে আছি কিন্তু ঘুম আসছে না। কি আর করা। কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে এনে সোফায় বসলাম। ক্লান্ত কিন্তু চোখে একফোঁটাও ঘুম নেই। মাথায় এখনোও পুরনো দিনের রেকর্ডিংয়ের রীল ঘুরে চলছে। যেন স্মৃতির হাট বসেছে আজ। একদিকে সুখের পসরা অন্যদিকের দূঃখের বিলাসী পণ্য। কলেজের কথা, বদরপুরের নস্টালজিক সময়ের কথা মন থেকে সরাতে পারছি না আজ।
শনিবার যেন আসতেই চায়না। প্রায় দুমাস পর খোলাখুলিভাবে কথা হবে এবার মৌসুমীর সাথে। অনেক প্রশ্ন আছে। অনেক কথা জানার আছে, বলারও আছে। এই কদিন শরীরটা কি খারাপ গেলো। পড়াশোনা কিচ্ছু হয়নি। কয়েকদিন পর মিড টার্ম পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। আমার কোনো প্রিপারেশন নেই। একমাত্র মেটাফিজিকেল পোয়েট্রি আর রোমান্টিসিজম ছাড়া বাকি সব খানেই গোল্লা পাবো এবার। পাসকোর্স তো খুলেই দেখিনি।
শুক্রবার কোন এক ছুটির দিন থাকায় কলেজ বন্ধ ছিল। এর পর এলো শনিবার। শনিবার আমাদের হাফ ডে থাকে। দুপুরেই ক্লাস শেষ হয়ে যায়। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে মৌসুমীর সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছি কয়েকবার। ঠিক হয়েছে, ক্লাস শেষ হয়ে গেলে ও রিকশা নিয়ে পৌঁছে যাবে বদরপুর ঘাটের সঙ্গীতা রেস্তোরাঁয় আর আমি সাইকেল নিয়ে পৌঁছে যাব। ওর সাথে ওর এক বন্ধুও যাবে, কথা হয়ে গেছে। যথারীতি তিনটে নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম। ওর সাথে এসেছে ওর বান্ধবী মঞ্জুশ্রী। ক্ষুধা লেগেছিল। তিন প্লেট এগ চাউমিনের অর্ডার করলাম। ও খেতে চাইছিল না। জোর করায় এক দু চামচ খেলো। ওর মুখের একরাশ দুশ্চিন্তার ছবি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত এর সাথে মিশে আছে দূঃখ আর আশু বিপদের অশনি সংকেত। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে খুলে বলো। ও আরম্ভ করলো এবার।
চলুন, মৌসুমীর মুখেই শুনা যাক:
"আমি উধারবন্দ হাইস্কুলে মেট্রিক দিয়েছি। এর আগের পড়াও ওখানে। মেট্রিক পাস করার পর বাবা আমাদেরকে পাঁচগ্রামের ভাড়া ঘরে নিয়ে এলেন যাতে মা বাবার সাথে থেকেই আমি কলেজের পড়াশোনা করতে পারি। মেট্রিক ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছিলাম। সাথে ইংরেজি ও হিন্দিতে লেটার মার্ক ছিল। বাবা বদরপুরের নবীন চন্দ্র কলেজে ভর্তি করে দিলেন হায়ার সেকেন্ডারি ফার্স্ট ইয়ারে। আমাদের ক্লাসে ছিল প্রায় চল্লিশ জন ছাত্র ছাত্রী। ক্লাসেই জুবায়েরের সাথে পরিচয়। ও চরগোলা থেকে ক্লাস করতে বদরপুর কলেজে আসত। ওদের একটি লাইন হোটেল আছে করিমগঞ্জ আর চরগোলার মাঝখানে হাইওয়ের পাশে।
একদিন আমার দেরি হয়ে যাওয়ায় লজিকের ক্লাস মিস হয়ে যায়। স্যারের বকুনি খাওয়ার ভয়ে আমি ক্লাসে না গিয়ে বাইরেই থাকলাম। স্যার বেরিয়ে গেলে ক্লাসে গিয়ে জানতে পারলাম আজ পরীক্ষায় আসতে পারে এমন কিছু ইম্পর্টেন্ট কোয়েশ্চন দেয়া হয়েছে। কলেজ শুরু হওয়ার তখনও বেশিদিন হয়নি। এখনও কেউ আমার বন্ধু হয়ে উঠেনি। ক্লাস শেষ হওয়ার পর সবাই চলে যাচ্ছিল। দেখলাম এক কোনে জুবায়ের বসে আছে। ওর কাছ থেকে আজকের দেয়া নোট নিতে চাইলাম। ও খাতা বের করে দিল। এভাবেই আমার আর জুবায়েরের পরিচয়।"
এতটুকু বলে চাউমিনের প্লেট ছেড়ে দিয়ে মৌসুমী জল খেলো। আমি আর মঞ্জুশ্রী ওর দিকে চেয়ে আছি। আমি দেখতে পাচ্ছি মৌসুমীর মন ভালো নেই। অতীতে এমন কি ঘটে গেছে যে আজ বলতে গিয়েও ওর মুখে কালো ছায়া নেমে আসছে? ঐ অতীত বর্তমানের সঙ্গে কতটা মিলে আছে, সেটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। চাইলেও কিন্তু কি হয়েছে তা অনুমান করা যাচ্ছে না, তাই ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।
জল খেয়ে মৌসুমী আবার শুরু করলো:
"এরপর আমরা ক্লাসে এলেই অনেকক্ষণ একে অন্যের সাথে কথা বলতাম। টিফিনের সময় কেন্টিনে গিয়ে গল্প করতাম। ও প্রায়ই ক্লাস মিস করতো আর পরে আমার কাছ থেকে নোট নিতে আসতো। জুবায়েরের পরিবারের গল্প বড় করুণ। ছোট বেলায় ওর মা আর এক মাত্র বোন বাস দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ওর মা খুব অসুস্থ ছিলেন। গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছিল। তখন জুবায়ের মাত্র সাত বছরের আর ছোটো বোনের বয়স চার বছর। চিকিৎসা করে বাড়ি আসার পথে ওদের নাইট সুপার শিলংয়ের পাশে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়। মোট সাতজন যাত্রি দুর্ঘটনায় মারা যান। এর মধ্যে ছিলেন জুবায়েরের মা ও ছোটো বোন। যখন জুবায়ের তার মায়ের আর বোনের মৃত্যুর ঘটনা বলে তখন আমি কেঁদে কেঁদে অস্থির। মাত্র সাত বছর বয়স হলেও জুবায়ের বোঝতে পেরেছিল মা বলে ডাকার আর কেউ নেই ওর। ওর ঘটনা শুনে আমি খুব দূঃখ পেলাম। সেদিন থেকেই জুবায়েরকে দেখলে ওর প্রতি খুব মায়া হতো। আমি চাইতাম ওর জীবনে যেন আর এমন কোনো দূঃখ না আসে। "
এতটুকু শুনে আমাদের চোখেও জল। মৌসুমীকে শান্ত করা যাচ্ছিল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল ওর হাত ধরে চোখ মুছিয়ে দেই। কিন্তু সেটা হয়তো প্রকাশ্যে ভালো দেখায় না। পকেট থেকে রুমাল বের করিয়ে দিতে চাইলাম। ততক্ষন ও ওড়নায় চোখ মুছে নিয়েছে। এই সময় রেস্তোরাঁর মালিক এসে জিজ্ঞেস করলেন আমাদের আর কিছু চাই কি না। দুপুরের খাওয়ার সময় থাকায় রেস্তোরাঁয় অনেক কাস্টমার যাওয়া আসা করছেন। কিছু না লাগলে আমাদের যাওয়া উচিত। আকারে ইঙ্গিতে এমনই বুঝিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। আমরা রেস্তোরাঁ থেকে বিল দিয়ে বেরিয়ে এলাম। এদিকে মঞ্জুশ্রীও যেতে চাইছে। জুবায়ের আর মৌসুমীর বিষয়ে এখনও অনেক কিছু জানার আছে। আমি আর মৌসুমী একটি রিক্সা ডেকে মঞ্জুশ্রীকে বসিয়ে দিলাম। ও রেল কলোনিতে থাকে। রিক্সা মঞ্জুশ্রীকে নিয়ে চলে গেলো। আমরা এখন কোথায় যাই ভাবছিলাম। হঠাৎ মনে এলো পায়ে হাঁটা দুরত্বে একটি ঐতিহাসিক দুর্গ আর এর সাথেই ছোট্ট একটি পার্ক আছে। ওখানে গিয়ে আরামসে বসে গল্প করা যায়। পার্কে গিয়ে নদীর পারে একটি খালি বেঞ্চ পেয়ে বসে পড়লাম। পেছনে ঐতিহাসিক দুর্গ আর সামনে জল ভর্তি বরাক নদী।
মৌসুমী আবার শুরু করল জুবায়েরের কথা:
"আমি আর জুবায়ের ফার্স্ট ইয়ারে খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। ওর জীবনের দূঃখ যেন শেষ হতে চায় না। ভাবতাম আমি সবসময় ওর পাশে থাকবো। ওর মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আরেক বিয়ে করেন। ঐ মহিলা জুবায়েরকে মোটেও পছন্দ করতেন না। কারণে অকারণে শারীরিক নির্যাতন করতেন। ক্লাস নাইনে থাকার সময় অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একবার ও বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পরে ওর বাবা খবর পেয়ে ওর মামার বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে আসেন। জুবায়ের পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হওয়ার কয়েকদিন পর জুবায়ের একদিন বায়না ধরে আমাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। আমি তো আর এভাবে যেতে পারি না। মা শুনলে আমাকে মেরে ফেলবে। অনেক পীড়াপীড়ির পরও আমি ওর সাথে একা কোথাও যাওয়ার জন্য রাজি হলাম না। কিন্তু তখনও আমাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
কয়েকদিন পর ও আমাকে প্রোপোজ করে বসে। ও নাকি আমাকে খুব ভালোবাসে। আর গ্রেজুয়েশন করার পর আমাকে নাকি বিয়ে করতে চায়। ছেলে আর মেয়ের সাধারণ বন্ধুত্বের উপরে যে আরেকটি সম্পর্ক থাকে আর বিয়ের আগে কোনো বিশেষ সম্পর্ক থাকা উচিত কি না তা ঝালিয়ে নেওয়ার বুদ্ধি আমার তখনও হয়নি। তবে স্কুল কলেজে অনেকেই প্রেম করে, একসাথে ঘুরতে বা সিনেমা দেখতে যায় সেটা জানতাম। জুবায়ের আমার কাছ থেকে উত্তর চায়। আমি ওকে ভালবাসি কি না। আমি জানতামনা বা বোঝতে পারতাম না কি উত্তর দেবো। ও যখনই বায়না ধরতো আমি বলতাম পরে জানাবো। এভাবে চললো কয়েকদিন। কিন্তু আমি বোঝতে পারতাম এই ভালোবাসার কথা আসার পর থেকে আমাদের মাঝে এক জড়তা এসে গেছে। আগের মতো খোলাখুলি ভাবে ঠিক কথাবার্তাও হয় না। এক দু দিন পর পর জুবায়ের আমার কাছ থেকে উত্তর খুঁজে। যেন আমাকে হ্যা বা না বলতেই হবে। আমার হ্যা বলতে ইচ্ছে হয় না আর না বললে ও নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাবে, তাই চাইলেও বলতে পারছি না।
এর কয়েকদিন পর, একদিন ক্লাস শেষ হওয়ার পর জুবায়ের আমার রাস্তা আটকে ফেলে। জানতে চায় আমি কেন আগের মতো ওর সাথে গল্প গুজব করি না, কেন বলি না যে আমি ওকে ভালবাসি। বললাম, 'আমাকে সময় দাও। আমি কি উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছি না'। ও আমাকে ক্লাস থেকে বাইরে আসতে দিচ্ছিল না। যেন এক্ষুনি ওর জবাব চাই। আমার খুব রাগ উঠে গেলো। আমি ওকে রাগের মাথায় বসিয়ে দিলাম এক চড়! আর ধাক্কা মেরে বাইরে চলে এলাম।"
মৌসুমী এতক্ষণ এসব বলে হাঁপিয়ে উঠেছে। কিন্তু গল্প এখনও শেষ হয়নি। আমি এতসব শুনে তাজ্জব হয়ে গেছি। ছিপছিপে মৌসুমীর ডান হাতের কব্জিতে কতটা জোর থাকতে পারে আর ঐ চড় খেয়ে জুবায়েরের মুখ দেখতে কেমন হয়েছিল তার অনুমান করতে গিয়ে আমার হাসি উঠে গেল। ব্যস, এবার ম্যাডামের রাগ উঠে গেলো। ও ভাবছে আমি হয়তো সিরিয়াসলি নিচ্ছি না। বললাম, 'বলে যাও, আমি শুনছি।' কিন্তু মৌসুমী উঠে দাঁড়িয়েছে। সাঙ্ঘাতিক রাগ উঠেছে ওর। কি করা যায় ভেবে হয়তো আমাকে একটু অসহায় দেখাচ্ছিল। কেন যে হেসে ফেললাম!
এবার ও নিজেই বললো:
-- নাহ, আজ থাক।
-- শেষ করো আজই।
--দেরী হয়ে যাচ্ছে।
-- ঠিক আছে। আবার কখন বলবে?
-- সোমবার। ঐদিন ক্লাস বাঙ্ক করি, চলো।
-- মেজরের দুটো ক্লাস করে বেরিয়ে আসবো।
-- ঠিক আছে। এখানেই আসব। তোমার ঐ ফালতু রেস্তোরাঁয় যেতে হবে না।
-- ঐ রেস্তোরাঁ আমার নয়।
-- নাহ, আজ থাক।
-- শেষ করো আজই।
--দেরী হয়ে যাচ্ছে।
-- ঠিক আছে। আবার কখন বলবে?
-- সোমবার। ঐদিন ক্লাস বাঙ্ক করি, চলো।
-- মেজরের দুটো ক্লাস করে বেরিয়ে আসবো।
-- ঠিক আছে। এখানেই আসব। তোমার ঐ ফালতু রেস্তোরাঁয় যেতে হবে না।
-- ঐ রেস্তোরাঁ আমার নয়।
বদরপুর ঘাট থেকেই ওকে পাঁচ গ্রামের বাসে উঠিয়ে দিলাম। ততক্ষন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভাবছিলাম জুবায়েরের কথা। এর পর কি হলো কে জানে? কিন্তু তখনও অনুমান করতে পারিনি আগত দিন কি ভয়াবহ হতে চলছে! ত্রিকোণ প্রেমের করুণ পরিণতি না খুব ভালো বন্ধুত্বের নিষ্পাপ গল্প, তখনও জানতাম না।
"জুবায়েরকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে এসে আমার খারাপ লাগছিল। এটা কি ঠিক করলাম? একটি মাতৃহারা ছেলে যার জীবনে দূঃখ ছাড়া আর কিছুই নেই তাকে এভাবে চড় মারাটা অন্তত ঠিক হয়নি। ওর বাবাও ওকে কারণে অকারণে মারধর করেন। খারাপ লাগছিল। কিন্তু ওর আমাকে এভাবে আটকে রাখার চেষ্টা করা কি ঠিক ছিল? আমার ধৈর্য্য নেই, ভীষণ রাগ। এই হুট করে যে রাগ উঠে যায় তা আমার পৈতৃক সম্পত্তি। যেমন আমার বাবার শর্ট টেম্পারি, আমারও তেমনি। বার বার বলছিলাম আমাকে যেতে দে, কিন্তু ও আমাকে বাইরে আসতে দিচ্ছিল না। আজই বলতে হবে ওকে। সত্যি কথা আমি ওকে ভালবাসি কি না জানি না। ভালোবাসা কি আমাকে কে বোঝাবে? একটি ছেলের প্রতি একটি মেয়ের টান থাকতেই পারে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ নিশ্চয়ই জৈবিক ব্যাপার। কাগজে কলমে, গল্পে উপন্যাসে যে ভালোবাসা লেখা থাকে বা দেশ বিদেশের লাখ লাখ কবিরা যে প্রেম নিয়ে কবিতা লিখে যান সেই ভালোবাসার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। হ্যা, যখন গল্প বা কবিতা পড়ি তখন মনে হয়, হয়তো প্রেম আছে। যে প্রেমের জন্য মানুষ সবকিছু ছেড়ে দিতে পারে। মরে যেতে পারে কিংবা কাউকে মেরে ফেলতে পারে। জুবায়েরের সঙ্গে জৈবিক হোক আর মানসিক টান, আমার কিছুই অনুভব হয়না।"
এতটুকু বলে ব্যাগ থেকে বোতল বের করে জল খেলো মৌসুমী। আমি আর মৌসুমী বসে আছি ঐতিহাসিক দুর্গ সংলগ্ন পার্কে। আজ সোমবার। মাত্র দুটো ক্লাশ করে চলে এসেছি। কলেজের এটাই সুবিধা। যখন খুশি বেরিয়ে যাও কেউ কিচ্ছু বলবে না। আমি আর মৌসুমী আজ একসাথে অনুপস্থিত তা অনেকের হয়তো নজরে পড়বে। হয়তো ভাববে আমাদের মধ্যে কিচ্ছু একটা চলছে। যার যা ইচ্ছা ভাবুক আমারতো বয়ে গেছে। মৌসুমীও খুব একটা পরোয়া করে না। শনিবারে এসেছিলাম এখানে কিন্তু জুবায়েরের গল্প শেষ হয়নি। তাই আজ আবার একই জায়গায়। নদীর পারে একটি ঐতিহাসিক দূর্গ আর এর পাশে এই পার্ক। গাছপালা, পাখির কিচিরমিচির আর তিন চারখানা লোহার বেঞ্চ। একখানা বেঞ্চে আমরা বসে আছি। পার্কে মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া আর জলের কলকল শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই। খালি আমি আর ও। মৌসুমী জল খেয়ে আবার শুরু করলো।
"ঐ দিনের ঘটনার পর আমি জুবায়েরের সঙ্গে কথা বলা ছেড়ে দিলাম। একবার মনে হলো ওকে অন্তত স্যরি বলা উচিত কিন্তু পরে ভাবলাম দোষ তো খালি আমার নয়। এভাবে চুপচাপ কয়েকদিন চললো। কয়েকদিন পর নবীন বরণ অনুষ্ঠান এলো। অনুষ্ঠানের দুএকদিন আগের কথা। আমাদের ক্লাস না থাকায় আমি একা লাইব্রেরীতে বসে আছি। দেখি জুবায়ের আসছে। সোজা আমার সামনে এসে বললো আমার সঙ্গে নাকি ওর কথা আছে। ওর সঙ্গে অন্য কোথাও যেতে হবে। মানে যেখানে লোকজন নেই এমন কোনো জায়গায়। ওর চোখে এক আকুল আবেদন ছিল। যেন হাত জোড় করে বলছে আমাকে যেতে হবে। মানাতে পারলাম না নিজেকে। উঠে দাঁড়ালাম। কোথায় যাই? ও বললো কলেজের ছাঁদে যাওয়া যায়। দুতলার পুরনো কলেজ বিল্ডিং। হায়ার সেকেন্ডারি সেকেন্ড ইয়ারের রুমের পাশেই ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি। ওর সাথে চলে গেলাম। বললাম কি হয়েছে বলো। ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে কেউ নেই। আমি আর জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছি। ও কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। পাঁচ মিনিট চুপচাপ থাকার পর আমি বললাম:
-- কি হলো? আমি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না।
-- আমি বোধহয় তোর প্রেমে পড়ে গেছি মৌসুমী।
আমি চেয়ে আছি ওর চোখে, কি বলবো বুঝতে পারছি না। একসময় ও বললো আবার:
-- তোকে কোনো জবাব দিতে হবে না। খালি জেনে রাখ, তোকে সহজে ভুলা যাবে না।
-- কেন? আমাকে কেন মনে রাখতে হবে? আর আমি বোধহয় তোকে সহজেই ভুলে যাবো। খুব একটা মনে আসেও না তোর কথা। প্রেম টেম হবে না। স্যরি।
-- আমি জানি।
-- জানিস যদি ভুলে যা। এসব নিয়ে আমার কথা বলার ইচ্ছে নেই। আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।
-- কি হলো? আমি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না।
-- আমি বোধহয় তোর প্রেমে পড়ে গেছি মৌসুমী।
আমি চেয়ে আছি ওর চোখে, কি বলবো বুঝতে পারছি না। একসময় ও বললো আবার:
-- তোকে কোনো জবাব দিতে হবে না। খালি জেনে রাখ, তোকে সহজে ভুলা যাবে না।
-- কেন? আমাকে কেন মনে রাখতে হবে? আর আমি বোধহয় তোকে সহজেই ভুলে যাবো। খুব একটা মনে আসেও না তোর কথা। প্রেম টেম হবে না। স্যরি।
-- আমি জানি।
-- জানিস যদি ভুলে যা। এসব নিয়ে আমার কথা বলার ইচ্ছে নেই। আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।
আমি চলে এলাম। জুবায়ের কাঁদছিল সম্ভবত। কিন্তু আমার মনে ওর জন্য একফোঁটাও অনুভূতি নেই। এই কদিন আমি অনেক ভেবেছি। কিন্তু একবারও মনে হয়নি যে আমার মনে ওর জন্য আলাদা কোনো স্থান আছে। আমি হয়তো ওকে মিছে শান্তনা দিতে পারতাম কিন্তু এভাবে ওকে কি ঠকানো হতো না?"
এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেলো আমার। অবশ্যই জুবায়েরের জন্য! মৌসুমী আমার দিকে চেয়ে আছে। ওরও কি মন খারাপ? সম্ভবত জানতে চাইছে আমি কি ভাবছি। এই মেয়েটি অন্তত সৎ। অবশ্যই শ্রদ্ধার পাত্র। জুবায়ের যতটা প্রেমিক তার থেকেও বেশি শিষ্ট ও শালীন মৌসুমী। এ এক ভালো লাগার অনুভূতি। মৌসুমীর মতো মেয়ে আজকাল খুব কমই আছে। জুবায়েরের গল্প ততটুকুই কিন্তু ও এখনও ভাবে একসময় মৌসুমী মেনে নেবে ওর কথা। কিন্তু এটা সত্য ওর প্রতি মৌসুমীর কোনো টান নেই। এজন্যই মৌসুমীর প্রতি আমার ঘনিষ্ঠতা দেখে ওর আমার প্রতি ঈর্ষা হয়েছিল?
মৌসুমীকে খুলে বললাম ঐদিনের ঘটনা। জুবায়ের কয়েকজনকে নিয়ে আক্রমণ করতে এসেছিল বাসস্ট্যান্ডে। মৌসুমী এসব শুনে আমার আরও পাশে এসে বসলো। কয়েকমিনিট চুপচাপ বসে আছে। আমিও। যেন আমাদের কথা ফুরিয়ে গেছে।
-- আমাকে খুব পছন্দ কর?
--(মাথা নাড়লাম)
-- কিন্তু কেন? আমি তো আর অতো সুন্দর নই।
-- ওকে।
-- তবে কেন আমি? আরও হাজারটা মেয়ে আছে কলেজে।
-- জানি। আমি তো আর মেয়ে খুঁজে বেড়াই না। আই লাইক ইউ, ব্যস এতটুকুই। কেনো, জানি না। তবে তুই না হলে অন্য কাউকে চাইতে হবে, এমন খারাপ অবস্থা হয়নি এখনও।
-- আমি ছাড়া কি চলবে না?
-- না।
-- যদি মানা করে দেই কি করবে? জুবায়েরের মতো পথ আটকে আক্রমণ করবে?
এবার আমার হাসি পেল।
-- দেখছ নদী? ঠেলে জলে ফেলে দেব!
--(মাথা নাড়লাম)
-- কিন্তু কেন? আমি তো আর অতো সুন্দর নই।
-- ওকে।
-- তবে কেন আমি? আরও হাজারটা মেয়ে আছে কলেজে।
-- জানি। আমি তো আর মেয়ে খুঁজে বেড়াই না। আই লাইক ইউ, ব্যস এতটুকুই। কেনো, জানি না। তবে তুই না হলে অন্য কাউকে চাইতে হবে, এমন খারাপ অবস্থা হয়নি এখনও।
-- আমি ছাড়া কি চলবে না?
-- না।
-- যদি মানা করে দেই কি করবে? জুবায়েরের মতো পথ আটকে আক্রমণ করবে?
এবার আমার হাসি পেল।
-- দেখছ নদী? ঠেলে জলে ফেলে দেব!
কিছুক্ষণ চুপচাপ। ও আমার আরও পাশে এসে বসে আছে। সম্ভবত তখন দুপুর দুটো হবে। আমার হাত ওর হাতে উঠিয়ে নিল। এ এক বিশ্বাস। এমনি এমনি জনমানবহীন পার্কে খুব গভীর বিশ্বাস না হলে কেউ এতো কাছে এসে বসে না বা হাত ধরে কথা বলে না।
বললো-
-- ইয়েস। সম্ভবত তোমার প্রতি আমার একটি আলাদা অনুভুতি আছে।
-- তার মানে? এত কঠিন কথা আমার মাথায় ঢুকে না।
-- আমাকে সময় দাও। ভাবতে দাও। ততক্ষন কি আমরা বন্ধু হয়ে থাকতে পারি না?
-- ইয়েস। সম্ভবত তোমার প্রতি আমার একটি আলাদা অনুভুতি আছে।
-- তার মানে? এত কঠিন কথা আমার মাথায় ঢুকে না।
-- আমাকে সময় দাও। ভাবতে দাও। ততক্ষন কি আমরা বন্ধু হয়ে থাকতে পারি না?
আমি আমার হাত টেনে নিয়ে একটু দুরে চলে এলাম। অভিমান! ওর জবাব আমার যে পছন্দ হয়নি সেটা বোঝতে পেরেছে। আবারও কাছে চলে এলো। জোর করে আমার হাত টেনে নিয়ে বললো - "আমিও তোমাকে ভীষন ভীষণ ভালোবাসি।"
আমি কি ঠিক শুনলাম! এসব সম্ভবত স্বপ্ন নয়। নদীতে ঠিকই জল বয়ে চলছে। ওপারে কাটিগড়া চৌরঙ্গীর লোকদের চলাফেরা দেখা যাচ্ছে। আজ আমার জ্বরও নেই। আগামীকাল মহালয়া। নদীর ওপারে এই ভরদুপুরেও মন্ডপ বানিয়ে চলছে কারিগররা। বাতাস বইছে। নাম না জানা ফুল ফোটে উঠেছে পার্কের এখানে ওখানে। একটা একটা করে ঐ সবকটি ফুলের রং বলে দিতে পারি এক্ষুনি। এসব মিথ্যে নয়, স্বপ্ন নয়। আমার চোখের সামনের এই দুনিয়া বাস্তবিকই, কোনো ঘোরে অনুমান করা অর্ধসত্যও নয়। আমার পাশেই বসে আছে মৌসুমী। এক প্রশান্তি ওর মুখে। যেন অনেক দিন থেকে আটকে রাখা কথা বলা হয়ে গেছে আজ। সবকিছু শান্ত। কয়েক বছর আগের সেপ্টেম্বরের এক নিঝুম আলোকোজ্জ্বল দুপুর। যেন শুধু আমরাই আছি, আর কেউ নেই। মনে হচ্ছিল থেমে থাকুক এই পৃথিবী। এই দিন, এই সময় আর এই পার্ক বন্দি করে রাখা থাকুক সময়ের ক্যানভাসে। এই মুহূর্তটি থেকে বেরিয়ে আসতে মোটেও ইচ্ছে নেই। আমারও নেই, মৌসুমীরও নেই।
পরিচয় থেকে পরিণয়, ভালোবাসার প্রতিটি ক্ষণ যেন আবেগঘন রঙিন স্বপ্নে বোনা এক রুপকথার গল্প। সেই রুপকথার গল্পে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের সাথে কাটানো প্রতিটি অপরূপ দিনের কথা আজও মনে আছে। ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল, ছিল নিতান্তই 'নর্মাল'। কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে সাদামাটা জীবন বদলে গেল। আমি আর আমি থাকলাম না।
কখনও হইচই পছন্দ করতাম না। এরপর আরও আলাদা হয়ে থাকতাম। ক্লাস ছাড়া কলেজের বাকি সব হইহুল্লুড় থেকে দূরে থাকতাম। ক্লাসের সবাই ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেন আমার আর ওর বিষয়ে। কলেজে এলে ঠাঁয় চেয়ে থাকতাম ওর মুখের দিকে। যেন চেনা অচেনা সব সুর চোখে জমিয়ে রাখতো ও। আমি অপলক চেয়ে থাকলে লজ্জা পেতো। মুখ নামিয়ে নিত। ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমি বসে রইতাম। যাওয়ার সময় আস্তে করে ও আমার পিঠে চিমটি কেটে যেতো। সেই একটু ছোঁয়া। অভুতপূর্ব অনুভূতি। এসব ছোটখাটো ঘটনা ভুলা যাবে না। মনে থাকবে চিরদিন।
ক্লাস শেষে রোজ ও কেন্টিনে যেত। আমাদের একটি বেঞ্চ মোটামুটি রিজার্ভ ছিল। বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। রাজ্যের যত বিষয়, সব নিয়ে আলোচনা হতো। কবিতা আর গান মৌসুমীর দুই প্রিয় সাবজেক্ট। খুব ভালো গলা ছিল না। কিন্তু গুনগুনিয়ে আমাকে শোনাতো ওর প্রিয় গান। ওর সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল, 'এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু, কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন, মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু'। এর আগে আকাশ বাতাস, প্রকৃতি এসব খালি অবজেক্ট ছিল। এখন দেখি সবকিছুর এক আলাদা সৌন্দর্য আছে। রাতগুলো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে বাড়তে থাকতো। আমার চোখে ঘুম খুব কম আসতো। কখন যে সকাল হবে আর আবার কলেজে যাবো। এসব ভাবনায় পড়াশোনা হচ্ছিল না। সেই বাঁশ আর টিন দিয়ে বানানো মেজরের ক্লাস যেন আমার জন্য অপেক্ষা করে রোজ রোজ। মোটামুটি সব দিনই আমি আগে ক্লাসে পৌঁছে যেতাম আর অপেক্ষা করতাম। শরৎকালের শেষ সময়। তখনও সবুজে ভরা চারদিক। ক্লাসে গিয়ে ডায়েরি রেখে সামনেই ঘাসের গালিচায় বসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতাম। নির্ভেজাল অক্সিজেন। এরপর মিস্টি অপেক্ষা। ও আসার জন্য অপেক্ষা করার এক একটি মুহূর্ত উপভোগ করতাম। একসময় আসবে ও। দুর থেকে তাকিয়ে থাকতাম। ওর হাসি হয়তো সবার মতো স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু আমার চোখে অপরুপ মনে হতো। ভাবতাম আর মনে প্রাণে চাইতাম ও সবসময় হাসতে থাকুক। দূঃখ কষ্ট যেন ওর ধারে কাছেও না আসে। কিন্তু আমরা যা চাই তাই কি হয়?
মাঝে মাঝে ও উৎকণ্ঠায় থাকতো। ওর বাবার ডায়াবেটিস ছিল। হাই লেভেলের ডায়াবেটিস। ক্রমে শরীর অরও খারাপ হচ্ছিল। লাগাতার চিকিৎসার খরচের জন্য পরিবারে আর্থিক সমস্যা ছিল। ও আমাকে বলতো না। কিন্তু একদিন সকালে দেখি ওর মন খারাপ। নিশ্চয়ই ভেতরে এক তুফান চলছে। মেজর শেষ হওয়ার পর কেন্টিনে গেল না। আমি ডাকলাম কিন্তু জবাব নেই। সব ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমাকে বলল ও বাড়ি যাচ্ছে। ফ্যাকাশে চেহারা। কিছু একটা হয়েছে কিন্তু ও আমাকে বলতে চাইছে না। বললাম, চল একটু বসি কোথাও। নাহ আজ ওর বসার ইচ্ছে নেই। আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কি হলো ওর? আমাকে বলছে না কেন? সত্যিই ও চলে গেলো। অন্যদিন আমি বাসে উঠিয়ে দিতাম। আজ আমার অপেক্ষা না করেই চলে গেছে। খুব মন খারাপ হয়ে বাড়ি ফেললাম। তখন মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপ ফেইসবুক নেই আজকের মতো। অতএব পরের দিন না আসা পর্যন্ত কিচ্ছু জানা যাবে না। ঐ রাতই ছিল সম্ভবত আমার জীবনের প্রথম নির্ঘুম রাত। ঘুম আসা তো দুরের কথা এক মুহুর্তের জন্যও ওর আজকের করুণ মুখের ছবি ভুলতে পারছিলাম না। ওর গান, হাঁসি আর গল্প ছাড়া আজকের দিন কাটবে সেটা ভাবিনি। সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ। ঘুম নেই। সম্ভবত সকালের দিকে ঘুম এসেছিল। চোখ খুলে দেখি দশটা বেজে গেছে। কোনমতে স্নান করে না খেয়েই কলেজে। পৌঁছতেই এক প্রশান্তি। গেটেই দাঁড়িয়ে আছে মৌসুমী।
-- কি হলো আজ? এত দেরি?
-- রাতে ঘুমাতে পারিনি। উঠে দেখি দশটা।
-- মেজর মিস হলো তোমার। চৌধুরী স্যার তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।
-- আগে বলো তোমার কি হয়েছে?
-- পরে বলবো। চলো জলদি। ইলেক্টিভ বেঙ্গলি ১১.০০ টায়। দেরি হলে দত্ত স্যার ঢুকতে দেবে না।
-- রাতে ঘুমাতে পারিনি। উঠে দেখি দশটা।
-- মেজর মিস হলো তোমার। চৌধুরী স্যার তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।
-- আগে বলো তোমার কি হয়েছে?
-- পরে বলবো। চলো জলদি। ইলেক্টিভ বেঙ্গলি ১১.০০ টায়। দেরি হলে দত্ত স্যার ঢুকতে দেবে না।
ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, এখন আর চিন্তার ছাপ কালকের মতো নেই। কিন্তু আগের মতো সেই উজ্জ্বল চেহারার হাসিখুশি ভাব উবে গেছে। গতরাতে ও নিশ্চয়ই আমার মতো ঘুমাতে পারেনি। কিন্তু ওর কি অসুবিধা হতে পারে ভেবে পাচ্ছিলাম না। দত্ত স্যার একের পর তথ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন কিভাবে বাংলা গদ্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়ামের প্রভাব অপরিসীম কিন্তু আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছিল না। মৌসুমীর কি হচ্ছে আর ওর কোনো অসুবিধায় আমার মন মানসিকতায় কেমন প্রভাব সেটাই আমার কাছে মূখ্য ছিল এইমুহুর্তে। কোনোমতে ক্লাস শেষ হতেই আমি দৌড়ে গেলাম ওর কাছে। বললাম, 'চলো আজ ঘাটে যাই'। ও রাজি হলো না। বললো:
--অসুবিধা আছে, আমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে। বাবার শরীর খুব খারাপ। আর তোমার সঙ্গে অনেক জরুরী কথা আছে। কাল সকালে পাঁচগ্রাম চলে এসো। আগামীকাল মহালয়ার ছুটি। সকাল সাতটায় রেলগেইটের পাশে এসো। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে আমরা পাহাড়ের দিকে যাবো।
--সাইকেল নিয়ে যাবো?
--না। বাসে এসো।
--কোনো সমস্যায় আছো?
--হ্যা। অনেক বড়ো সমস্যা। সমাধান খুঁজতে হবে।
-- এক্ষুনি বলো! কি সমস্যা? আমি আরেকরাত না ঘুমিয়ে থাকতে পারবোনা।
-- বাহ্। বাবু আমার কালকে ঘুমাওনি? আমিও ঘুমাতে পারিনি।
এই বলে হাত দিয়ে আমার সারা চুল এলোমেলো করে দিয়ে ও ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো। ও না হয়ে অন্য কেউ হলে ভীষণ রাগ উঠতো। আমার কোঁকড়ানো চুল ঠিক করা কি যে ঝামেলা আমিই জানি। কিন্তু 'বাবু আমার'? কানে মৌ ঢেলে দেয়া শব্দদুটো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। নাহ্, এই নামে আমাকে কেউ ডাকেনি। আমি যতক্ষন হাঁদার মতো দাঁড়িয়েছিলাম ততক্ষন ও চলে গেছে। পাস কোর্সের ক্লাস আজ আমিও একা একা করবো না।
--অসুবিধা আছে, আমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে। বাবার শরীর খুব খারাপ। আর তোমার সঙ্গে অনেক জরুরী কথা আছে। কাল সকালে পাঁচগ্রাম চলে এসো। আগামীকাল মহালয়ার ছুটি। সকাল সাতটায় রেলগেইটের পাশে এসো। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে আমরা পাহাড়ের দিকে যাবো।
--সাইকেল নিয়ে যাবো?
--না। বাসে এসো।
--কোনো সমস্যায় আছো?
--হ্যা। অনেক বড়ো সমস্যা। সমাধান খুঁজতে হবে।
-- এক্ষুনি বলো! কি সমস্যা? আমি আরেকরাত না ঘুমিয়ে থাকতে পারবোনা।
-- বাহ্। বাবু আমার কালকে ঘুমাওনি? আমিও ঘুমাতে পারিনি।
এই বলে হাত দিয়ে আমার সারা চুল এলোমেলো করে দিয়ে ও ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো। ও না হয়ে অন্য কেউ হলে ভীষণ রাগ উঠতো। আমার কোঁকড়ানো চুল ঠিক করা কি যে ঝামেলা আমিই জানি। কিন্তু 'বাবু আমার'? কানে মৌ ঢেলে দেয়া শব্দদুটো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। নাহ্, এই নামে আমাকে কেউ ডাকেনি। আমি যতক্ষন হাঁদার মতো দাঁড়িয়েছিলাম ততক্ষন ও চলে গেছে। পাস কোর্সের ক্লাস আজ আমিও একা একা করবো না।
কলেজ থেকে এসে সময় কাটতে চাইছিল না। মাথায় হাজার দুশ্চিন্তা। এত অন্যমনস্ক কখনও হতাম না। আমাকে এই দুশ্চিন্তা থেকে পালাতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। সাইকেল নিয়ে রেলস্টেশন, কলোনি, বদরপুর ঘাট ঘুরে বেড়ালাম। দুর্গাপূজা আসন্ন। দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলাম কারিগররা মন্ডপ বানিয়ে চলছে। সাইকেল চালাতে চালাতে একসময় পায়ে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। রাত দশটায় বাড়ি ফিরলাম।
আমার একটি ছোট্ট কেসেট প্লেয়ার ছিল। আব্বা এনে দিয়েছিলেন। সারারাত গান শুনে কাটালাম। ঐসময়ে নচিকেতার গান খুব শুনতাম। নীলাঞ্জনা সিরিজ আমার প্রিয় ছিল। অনির্বাণের গান শুনলে মন খারাপ হয়ে যেত। আগে গান মানে সুর আর বাদ্যযন্ত্রের মধ্যেই থাকতাম। এখন গান মানে গানের কথা। যারা গান লেখেন তারা নিশ্চয়ই প্রেমে পড়েছিলেন। নইলে কিভাবে ওরা একদম মনের কথা লিখে দেয়? যত গান শুনি আরও বেশি ও কাছে নেই মনে হয়। এত দুরত্ব! দিনদিন বাড়ছে আমার ওর প্রতি এই আকর্ষণ।
উঠতে দেরি হবে এই ভয়ে এলার্ম লাগিয়ে ছিলাম। পাঁচটায় উঠে বাস ধরে সোজা পাঁচগ্রাম। মহালয়ার দিন। রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। উৎসবমুখর পরিবেশ সবখানে। রেলগেইটের সামনেই মৌসুমী দাঁড়িয়ে আছে। নামতেই আমাকে দুটো চকলেট দিল। ইস্ আমিও ওর জন্য কিছু আনতে পারতাম। আমাকে কে শেখাবে প্রেমে পড়লে কি করতে হয়? পাঁচগ্রামের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একখানা ছোট্ট সবুজ পাহাড়। এই পাহাড়েই এইচপিসির কাগজ কল। আশপাশে কাগজ কলে কাজ করা লোকদের কোয়ার্টার। চারপাশে অসংখ্য গাছপালা, বুনোফুল আর পাখির কিচিরমিচির। রেলগেট থেকে পাকা রাস্তা পাহাড়ের চূড়া অবধি এঁকেবেঁকে উঠে গেছে। দৈর্ঘ্য সম্ভবত তিন কিলোমিটার হবে। আমি আর মৌসুমী পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। আমার আর তর সইছিল না। জিজ্ঞেস করলাম আগে বলো এই কদিন কি হচ্ছে? তুমি চুপচাপ হয়ে গেছো। আমাকে এক্ষুনি বলো প্লিজ। মৌসুমী তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু কিচ্ছু বলছে না। আমি অপেক্ষা করছি ও কখন মুখ খুলে। প্রায় বিশ মিনিট চলার পর পাহাড়ের এক পাশে পার্কের আদলে বসার জায়গা বানানো। আমরা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। এতক্ষণ পায়ে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম দুজনেই। বসে হাঁপাতে লাগলাম। মৌসুমী ওর সাদা ওড়না দিয়ে আমার কপালে জমা ঘাম মুছে দিল। অসম্ভব সুন্দর অনুভূতি। এর পর মৌসুমী শুরু করলো ওর কথা:
"বাবা খুব অসুস্থ। আমি বোধহয় ডিগ্রিটাও কমপ্লিট করতে পারবো না। অনেক সিরিয়াস। যেকোনো সময় এডমিট করানো হতে পারে। বাবার কিচ্ছু হয়ে গেলে আমাদেরকে পাঁচ গ্রাম ছেড়ে গ্রামে গিয়ে থাকতে হবে। এর থেকেও বড় সমস্যা আমাদের বিষয়ে বাড়িতে কেউ ফোন করে বলে দিয়েছে। আমি নাকি ক্লাসে থাকিনা। সারাদিন তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। আমরা ঘাটে গিয়ে বসে থাকি সেসব মা কে বলেছে কেউ। মা আমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছে যে আমি যেন তোমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখি। বাবা এখনও জানেন না।"
ততক্ষনে আমার পৃথিবী দুলতে শুরু করেছে। পায়ের নিচে থেকে সরে যাচ্ছে মাটি। কপালে হাজার দুশ্চিন্তার রেখা আর চোখে জল। মৌসুমীও কাঁদছে। এই মহান কর্ম টি কি জুবায়েরের? আমি তো ওর কোনো ক্ষতি করিনি!
সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা এসে গেলো। পড়াশোনা আমার কিছুই হয়নি এবার। দু-এক খানা ছাড়া সব প্যাপারেই ব্যাক আসবে তা নিশ্চিত ছিল। এদিকে কয়েকদিন থেকে দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করেছে। মৌসুমীর বাড়িতে খবর পৌঁছে গেছে আমাদের বিষয়ে। কে যে বললো সেটাও এক রহস্য। আগে ভেবেছিলাম হয়তো জুবায়েরের কাজ। কয়েকদিন পর ওকে জিজ্ঞেস করলাম। মানা করলো। ও নাকি এসবে নেই আর। বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই। জুবায়েরের দলের সঙ্গে লড়তে পারি না।
মৌসুমীর অসুস্থ বাবা আবার আমরা ঘুরাঘুরি করছি শুনলে রাগ করবেন, তাই মৌসুমী আর আগের মতো নিরিবিলি আমার সঙ্গে দেখা করবে না বলে দিয়েছে। আমিও জোর করিনা। ওর সিদ্ধান্তকে বরাবরই সম্মান করতাম। নিজেকে অসহায় লাগতো। কিচ্ছু করার সাহস বা ক্ষমতা ছিল না। আমার মা বাবা আমাদের খবর পেলে এক্ষুনি কলেজ থেকে বের করিয়ে নিয়ে যাবে তাই কাউকে কিচ্ছু বলতাম না।
মহালয়ার দিন পাঁচগ্রামে সেই যে দু তিন ঘন্টা মৌসুমীর সঙ্গে ছিলাম এর পর আর এভাবে নিরিবিলি বসে কথা হয়নি। পূজোর বন্ধের পরই পরীক্ষা। সময়টা খুব খারাপ হয়ে এলো আমার। এই বন্ধের সময় পড়াশোনার কথা। রোজ রোজ চৌধুরী স্যার নোট দিচ্ছেন কিন্তু আমি পড়াশোনায় একটুও মনোযোগ দিতে পারছি না।
পাঁচগ্রাম থেকে আসার সময় মৌসুমী একখানা চিঠি হাতে গুজে দিয়েছিল। বেশিরভাগ কবিতার মতো কিছু লেখা। মোট আট পাতা ছিল। এত কঠিন বাঙলায় ও বোঝাতে চেয়েছে যে আমাদের দেখা ভাগ্যেই ছিল। অসুবিধাও আসবে যা আমাদের কপালে আগে থেকেই লেখা আছে। হয়তো শেষমেষ আমাদের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু ওর মনে আমার স্মৃতি চিরদিন থেকে যাবে।
দিস্তার কাগজে কালির কলম দিয়ে লেখা দুর্বোধ্য সব কবিতা স্ট্যাপলার মেরে দিয়েছে। একটিতে ও ওর দিন আর রাতের কথা লিখে দিয়েছে। কিভাবে আমাদের কথা ভাবতে ভাবতে ও আনমনা হয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠেই আবার আমাদেরই কথা মাথায় ভর করে। কেন্টিনে বসে আড্ডা দেয়ার কথা, ওকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে হাত নাড়িয়ে থাকা আর যতক্ষণ বাস চোখের আড়ালে চলে যায় নি ততক্ষণ আমি যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি এসব কথা, বদরপুর ঘাটের পার্কে বসে কাটানো সময়ের কথা এসব নাকি ও সারাদিন ভাবতে থাকে আর হাসতে থাকে। স্মৃতি বলতে এর বেশি তো কিছুই নেই। তবে ও কল্পনা করে, আমরা কোথাও গিয়েছি। নদী পাখি জঙ্গল আর আমরা। দিনের পর দিন ওখানে থাকছি। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, আর বিরক্তিকর কলেজ থেকে অনেক দুর, যেন এখনও এসব আবিস্কারই হয়নি। কেবল আমরাই আছি। জঙ্গলে কেবল আমরা দুজন। সকালে উঠে খাবার যোগাড় করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। অদ্ভুত অবাস্তব অকল্পনীয় লেখা সব ওর মাথায় আসে কি করে?
এসব লেখা পড়ে ওকে আরও রহস্যময়ী লাগছিল। যেন অনেক দুরের অচেনা কেউ। রোজ এসব পড়তাম আর ভাবতাম কখন কলেজ খুলবে আর ওর সাথে দেখা হবে। একদিন সময় বের করে ও আমাকে এসব কবিতার অর্থ বুঝিয়ে দেবে। আমি লেখালেখির ধারে কাছেও নেই। আমার একটাই চাওয়া। কলেজ চলতে থাকুক। আর যখন ইচ্ছা আমরা যেন দেখা করতে পারি। কোনো বাধা ছাড়াই যাতে আমরা বসে থাকতে পারি ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু আমার সময় কাটছে না এখন। কখন যে পূজো শেষ হবে আর আবার কলেজ শুরু হবে!
পূজোর দিনগুলোয় বদরপুর যেন সেজে উঠে। বিশেষ করে রেল কলোনি এরিয়া। দোকানে দোকানে ভিড়। সাজো সাজো রব সব জায়গায়। কলেজের ছেলেরা পূজোয় ঘোরাঘুরির প্লান বানালো। সবাই নাকি শিলচর যাবে মন্ডপ আর মানুষের ভীড় দেখতে, কেনাকাটা করতে। আমি একদিনও গেলাম না। এমনকি বাড়িতেও গেলাম না। একা থাকার মধ্যে একটি নেশা আছে সম্ভবত। নিঃসঙ্গ হলেও দুরে থাকা কারুর কথা ভাবতে ভাবতে সময় কাটানোর এক আমেজ আছে। কেউ কেউ হয়তো মানবেন একথা, কেউ ভাববেন আমার মাথায় দোষ আছে।
রোজ সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেতাম। ভীড় ঠেলে বরাকের উপর থাকা সেতু পার হয়ে কাটিগড়া চৌরঙ্গীতে যেতাম প্রায় ডেইলি। বরাকের ওপারে বারুণী মেলার মস্ত বড় মাঠ। নদীর তীর ঘেঁষে কমসে কম কয়েকশো বিঘার চর। প্রতিবছর মাঠে মেলা বসে। বছরের বাকি দিনগুলোতে সপ্তাহে একদিন বাজার হয়। আর ছয়দিন জনমানবহীন হয়ে পড়ে থাকে ঐ মাঠ। সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো মাঠের গা লাগিয়ে বয়ে চলছে আঁকা বাঁকা বরাক। ওখানে বসে রেলসেতু, বদরপুর শহর আর পাঁচগ্রাম দেখতে ছবির মতো মনে হতো। আরামসে বসে মৌসুমীর দেয়া কবিতা বার বার পড়তে থাকতাম। যেন এই আটটি পৃষ্ঠা ওর আর আমার মাঝের সেতু। ওর নীরব উপস্থিতি। এই কাগজগুলোই আমাদেরকে অবিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ডায়েরিতে আমিও অনেক কিছু লিখতে থাকতাম। চেষ্টা করতাম কবিতার মতো কিছু একটা লেখি যা মৌসুমীকে দেয়া যায়। কিন্তু যুতসই হতো না, তাই ছিঁড়ে ফেলে দিতাম বরাকের জলে। এভাবেই চলছিল ডিগ্রি ফার্স্ট ইয়ার।
বন্ধের পর আবার কলেজ শুরু হলো। আমাদের কথাবার্তা এই কদিন খুব কম হতো। তবে একে অপরের প্রতি যে টান আছে সেটা বোঝতে পারতাম। চোখে চোখে কথা হয়? হতে পারে। আমি চেয়ে থাকতাম ওকে। যেন হারিয়ে যেতাম। ওর চোখে পড়লেই ও হেসে উঠত। কখনও ও চেয়ে থাকত আর ধরা পড়লে চোখ নামিয়ে নিত। আমার ইচ্ছে হতো ওকে নিয়ে কোথাও গিয়ে বসি আর গল্প করি। দু একবার বললাম। ও রাজি হয়না। ওর বাবা শুনলে নাকি খুব খারাপ পাবেন। মৌসুমীর বাবা তখনও অসুস্থ। ওর মারও বয়স হয়েছে। প্রায়ই শরীর খারাপ থাকে। ঘরের অনেক কাজ মৌসুমীকে একাই করতে হয়। রান্নাবান্না, কাপড় কাঁচা সবকিছু করেই ও কলেজে আসত। কখনও মনে হতো ও খুব পরিশ্রান্ত। আগের রাতে অসুস্থ বাবার পরিচর্যায় রাতজাগার জন্য ক্লান্ত দেখাতো। আমার খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।
দেখতে দেখতে পরীক্ষা এসে গেলো। আমার আর মৌসুমীর দুজনেরই পরীক্ষা ভালো হলোনা। পরীক্ষার পর বাড়ি চলে এলাম। প্রায় তিনমাস ছুটি। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি ক্লাব খুললাম। ডেবোনেয়ার ক্লাব। বন্ধুবান্ধব এক হয়ে কোনো একটা ভালো কাজ করা, খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, একটি লাইব্রেরী করা এসব ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। হাইস্কুলে যারা একসাথে পড়েছি তাদের অনেককে নিয়ে এই ডেবোনেয়ার ক্লাব। আমিরুল কে সভাপতি আর আমাকে সম্পাদক বানানো হলো। মৃণাল, মনসুর, সামিম, নিজাম, জহিরুল, সালামদা, টিনা দিদি, বিধান সবাই ছিলেন সক্রিয় সদস্য। গণ্যমান্য অনেকের সাথে আমাদের তদানিন্তন স্থানীয় বিধায়ক সিদ্দিক দা ছিলেন উপদেষ্টা। কিন্তু আমাদের ক্লাব কোনদিনই রাজনীতির জন্য ছিল না। বারইগ্রামে আমাদের সিনিয়রদের আরেকটি ক্লাব ছিল। ওদের সংঘবদ্ধ হয়ে থাকা দেখেই আমাদেরও ক্লাব করার ইচ্ছে হলো। দেবাংশুদার বাড়ির সামনে ঘর ভাড়া করে শুরু হলো আমাদের ডেবোনেয়ার ক্লাবের যাত্রা। দিনের বেলা ফ্রীতে টিউশন শেখানো হতো। আমি, মনসুর, আমির, টিনা দিদি আর নিজাম কোনো টাকা না নিয়েই আশপাশের গরীব ছেলেমেয়েদেরকে কোচিং শুরু করলাম। বিকেল হতো জমজমাট আড্ডা আর কেরাম কম্পিটিশন। কয়েকদিন পর আমরা একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করলাম। আমরা সবাই দশটাকা করে মাসিক চাঁদা দিতাম। আর কোনো অনুষ্ঠানাদি হলে উপদেষ্টাদের কাছ থেকে চাঁদা কালেকশন করতাম। স্থানীয় অনেক শিক্ষক, রাজনীতিবিদ আর ব্যবসায়ীরাও আমাদের উপদেষ্টা মন্ডলীতে ছিলেন।
এসবের মাঝে ডুবে গিয়ে মৌসুমীর কথা ভুলে গেছিলাম। আসলে ভুলতে চাইতাম। অনেক দেরি করে বাজার থেকে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু একা হলেই মৌসুমীর কথা ভাবতাম। জানি না ও কি করছে, ওর বাবা মা কেমন আছেন। আমার কাছে ওদের বাড়ির ল্যান্ডলাইন নম্বর ছিল কিন্তু ফোন করতে ভয় হতো। যদি ওর বাবা ফোন উঠান তবে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সময় দ্রুত চলে যাচ্ছিল। পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার আগের দিন বদরপুর চলে গেলাম। তখন ইন্টারনেটে রেজাল্ট পাওয়া যেতো না। অফিসের সামনে থাকা নোটিশ বোর্ডে টাইপ করা লিস্ট লাগিয়ে দেয়া হতো। যারা আগে থেকেই জানে যে রেজাল্ট খারাপ হবে তারা যেতোই না। আর যারা পাশ করবে তারা হুমড়ি খেয়ে পড়তো। আমি জানতাম ব্যাক আসবে, তবুও গেলাম। কলেজে গিয়ে দেখি লিস্ট টাঙ্গানো হয়ে গেছে। আমার আর মৌসুমীর দুটো করে ব্যাক। অনেকের তিন চারটে ব্যাক। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মৌসুমী এলো। দুর থেকে দেখেই মন ভালো হয়ে গেল। কিন্তু একি! ও এত রোগা হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই শয্যাশায়ী বাবার পরিচর্যায় অনেক ধকল গেছে। সম্ভবত কয়েকদিন থেকে ও নিজেই অসুস্থ। তিনমাস আগের যে প্রাণবন্ততা, হাসি খুশি সব যেন গায়েব হয়ে গেছে। ওর অবস্থা দেখে চোখে জল এসে গেল। অনেকদিন পর কেন্টিনে গিয়ে বসলাম। মৌসুমী কেঁদে কেঁদে বললো, "বাবা বোধহয় বাঁচবেন না। ওষুধের উপরই আছেন। আমাকেও বোধহয় কলেজ ছেড়ে দিতে হবে। এখন মাও বিছানায়। আর কোন্ সময় বাবাকে এডমিট করাতে হবে ঠিক নেই। তুমি প্লিজ দোয়া করো। আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।" আমি কি বলে যে শান্তনা দেবো বুঝতে পারছি না। পড়াশোনা করে একটা ভালো জীবন হয়তো মৌসুমীর স্বপ্ন হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আর ওর বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে কলেজ ছেড়ে দিতে হবে, সেটা সবচেয়ে করুণ হবে। নিজেকে বড় ছোট মনে হচ্ছিল। আমি যদি অনেক বড় হতাম, চাকরি বা ব্যবসা করতাম তাহলে হয়তো কিছু একটা করতে পারতাম। মৌসুমী কেঁদেই চলছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে দিলাম।
রেজাল্ট ভালো না হওয়ায় বাড়িতে অজস্র বকুনি খেতে হলো। বাবা বিশ্বাস করতে পারছেন না যে দুটি পেপারে ব্যাক এসেছে। পড়াশোনা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই বারবার বুঝিয়ে যাচ্ছিলেন মা। যতটুকু রাগ করছিলেন তার থেকে বেশি দূঃখিত ছিলেন। আমার বাবার একটি গুণ ছোটবেলা থেকেই জানতাম। না বললেও আমার মনের কথা বুঝতে পারতেন। নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন যে ছেলে বড় হচ্ছে, মনের রোগ শুরু হওয়ার এটাইতো সময়। আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন সবকিছুর সময় আসবে। ধৈর্যের সঙ্গে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে লোকসান আমার নিজেরই হবে। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ যারা করে না তাদের কপালে দূঃখ থাকে। মাত্র দুই বছর মন দিয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি শেষ করলেই হলো। এরপর অনেক সময় থাকবে। তখন যা ইচ্ছা করতে পারি। মা ভাবতেন আমি ক্লাসের বই ছেড়ে গল্প উপন্যাস পড়ে সময় কাটাই। আমার সহজ সরল মা। বুঝতেই পারতেন না সমস্যা কোথায়। বাবা হয়তো অনুমান করতে পারতেন। সেই সময়েও বাবা আমার প্রাইভেসিকে সম্মান করতেন। কিছু গোপন করার চেষ্টা করছি বুঝতে পারলে জোর করে জানার চেষ্টা করতেন না। কিন্তু লক্ষ রাখতেন ঠিকই।
সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস যথারীতি শুরু হয়ে গেলো। মৌসুমী আর আমি ঠিক করলাম আগে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। আগের মতো ক্লাস কামাই করে আড্ডা মারলে চলবে না। সেকেন্ড ইয়ারে ব্যাক ক্লিয়ার করতে হবে আর অনার্স মার্ক না থাকলে উপায় নেই। ক্লাস কামাই বা সন্ধ্যার পর ঘুরাঘুরি বন্ধ করে দিলাম। কলেজে কোনো পিরিয়ডে স্যার না এলে কেন্টিনে গিয়ে বসতাম। একদিনও বাইরে যাইনি আর।
এরমধ্যে কলেজের লম্বা ছুটি এলো। মার কথা রাখতে তাবলীগ জামাতে চলে গেলাম। কাটাখাল, শালচাপরা আর শিলচরের বিভিন্ন মসজিদে চল্লিশ দিন কাটালাম। ঘনিয়ালা মরকজে তাবলীগ শেষ হলো। আমীর সাহেবের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। ফকিরাবাজারের এক মাদ্রাসার ইমাম ছিলেন আমীর সাহেব। জামায়াতের বিষয় ছাড়াও অনেক বাড়তি বিষয় জানতে পারলাম ওনার কাছ থেকে।
জামায়াতে যাওয়া আমার ছাত্র জীবনের এক সন্ধিক্ষণ ছিল। অনেক অজানা জিনিস জানতে পারলাম। এর আগে জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবতাম না। গড্ডালিকা প্রবাহে চলতে থাকা ছাত্র জীবনে তাবলীগ এক ইউ টার্নের মতো কাজ করলো। আমার চিন্তাধারার অনেক পরিবর্তন হলো। অনেক কিছু শেখা হলো যা তাবলীগে না এলে কোনোদিনই জানতাম না। জানতে পারলাম বিয়ের আগে অপরিচিত কোনো মেয়ের সঙ্গে শরিয়তের সীমা অতিক্রম করে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। কেন এই সীমাবদ্ধতা তাও বুঝিয়ে দিলেন আমীর সাহেব।
মৌসুমীর সঙ্গে বন্ধুত্ব এক সাংঘাতিক ভুল হয়ে যাচ্ছে বোঝতে পেরে খুব খারাপ লাগলো। একেবারে সবকিছু ভুলে যেতে হবে এটা মানতে পারছিলাম না। তবে এটা তখনই স্থির করে নিয়েছিলাম যদি আমাদের বন্ধুত্ব থাকে তবে তা হবে সম্পুর্ন শরিয়ত সম্মত। কোনো ভাবেই সীমা অতিক্রম করা যাবে না। বিয়ের আগে কোনো মেয়ের হাত ধরাও যাবে না, শারীরিক সংস্পর্শের প্রশ্নতো অনেক দূর!
বন্ধের পর ক্লাস শুরু হলো। একদিন ক্লাসে মৌসুমী অনুপস্থিত। ইদানিং ওর বাবার শরীর খুব খারাপ যাচ্ছিল। লাগাতার দুই তিন দিন ও কলেজে এলো না। এক বিকেলে সাহস করে পিসিও থেকে ওদের ঘরে ফোন করলাম। কেউ উঠালো না। পরের দিন শনিবার ছিল। কলেজে না গিয়ে সোজা পাঁচগ্রাম চলে গেলাম। আমি ওদের বাড়ি চিনতাম। একবার মৌসুমীর সঙ্গে দেখা করতে আসার সময় ও আমাকে ওদের ভাড়া ঘর দেখিয়ে দিয়েছিল। বাজারের পাশেই পুরনো একতলা বাড়ি। গিয়ে দেখি দরজায় তালা ঝুলছে।
ওদের ঘরের লাগোয়া আরেকটি ঘরে আরেক পরিবার ভাড়া থাকেন। তারাই বললেন, মৌসুমীর বাবার শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়ায় শিলচরের এক প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ইস্, মৌসুমী আমাকে একটা ফোন করতে পারত! হয়তো বিপদের সময়ে একটু পাশে থাকতাম, শান্তনা দিতে পারতাম। আমাকে খবর না দেয়ায় রাগ উঠছিল, দূঃখও হচ্ছিল। মা আর দুই মেয়ে ছাড়া ওদের পরিবারে দেখাশোনা করার মতো আর কেউ নেই। নিশ্চয়ই অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।
রাতে ঘুম হলোনা। পরের দিন রবিবার। কোনো চিন্তা না করেই শিলচরের হাসপাতালে চলে গেলাম। খুঁজে বের করতে অসুবিধা হলো না। হাসপাতালের বাইরে একটি চায়ের দোকানে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভেতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছিল না। ওর বাবা মা যদি জিজ্ঞেস করেন আমি কে তবে কি বলব। আমার আসা কি ঠিক হয়েছে, মৌসুমীর সঙ্গে দেখা হবে কি না এসব ভাবছি কিন্তু মৌসুমী বাইরে আসছে না। প্রায় দুঘন্টার পর অপেক্ষা শেষ হলো। দেখি মৌসুমী বেরিয়ে আসছে। পেছন থেকে ডাকবো কি না ভাবছি ততক্ষণে ও পাশের ফার্মাসিতে ঔষধ কিনতে পৌঁছে গেছে। দৌড়ে গেলাম। আমাকে দেখে ও হতভম্ব হয়ে গেছে। বললো ওর বাবার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। কখন কি হয় বলা যায় না। বললাম আমি ওর বাবাকে একবার দেখতে চাই। কোনো চিন্তা না করেই আমাকে নিয়ে চললো হাসপাতালের বেডে। ওর বাবার সাথে ক্লাসমেট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিল। বলল ওনার শরীর খারাপ শুনে দেখতে এসেছি।
মৌসুমীর বাবা ইশারায় সালামের জবাব দিলেন। কথা বলতে পারছিলেন না। সত্যিই অবস্থা খুব খারাপ। সুগারের রোগী, এর উপর হার্টের অসুখ। সেলাইন আর ইনসুলিনের উপর ঝুলে আছে জীবন। মৌসুমী ওর মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মা-মেয়ের মন খারাপ তা বোঝতে পারছিলাম কিন্তু ওরা ভেঙ্গে যায়নি। দুজন মহিলা কিভাবে হাসপাতালের ধকল সামলিয়ে গৃহকর্তার সেবা করে যাচ্ছিলেন তা অতুলনীয়। আমাদের অঞ্চলে এমন সাহসী মহিলা অনেক কম আছেন সম্ভবত।
হাসপাতালে সারা দিন থাকলাম। কিছু একটা করার প্রবল ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সঙ্গে থাকা ছাড়া কিই আর করতে পারি। দিনের বেলা অনেকেই দেখা করতে আসেন কিন্তু রাতে মা মেয়েকেই হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। ছোটো বোনকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন ওরা। এতদিন লাগাতার রাত জেগে মৌসুমীকে অসুস্থ দেখাচ্ছে। কি আর করবে! যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষন আশ। বিপদ আসলে পরিবারের লোকজনও ধীরে ধীরে কেটে পড়েন।
সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। মৌসুমী জোর করেই পাঠিয়ে দিল। পরের দিন আবার আসব আর রাতে ওদের সাথে হাসপাতালে থাকবো বলে চলে এলাম। মৌসুমীর মা নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন আমাদের বিষয়ে। কিন্তু কিছুই বললেন না। পরের দিন কলেজ শেষ হতেই সোজা হাসপাতালে চলে গেলাম। মৌসুমীর জন্য দুটো চকলেট, একখানা গল্পের বই আর দুটো ম্যাগাজিন নিয়ে গেলাম। ভাবলাম সময় কাটাতে বই পড়া হয়তো পছন্দ করবে।
হাসপাতালে ওরা একটি ছোট্ট রুম নিয়েছে। দুটো সিঙ্গল বেড। এক বেডে রোগি আর এক বেড এটেনডেন্ট থাকার জন্য। দুটো চেয়ারও আছে। আমি সারা রাত জেগে রইলাম। মৌসুমী আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল ওর বাবার অসুখ কমবে তো? আমি স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছিলাম। বলছিলাম ঠিক হয়ে যাবেন উনি। চিন্তা করার কিছুই নেই। রাতে তিন চার বার ডাক্তার এলেন। নার্স এসে ইউরিন ব্যাগ বদলে দিয়ে যাচ্ছিল। মা মেয়ে এক সময় একে একে ঘুমালো। চার পাঁচ দিন থেকে নিশ্চয় অনেক ধকল যাচ্ছে। আমাকে অনেক বিশ্বাস করছেন মৌসুমী আর ওর মা। যেন ঘরের ছেলে আমি। কোনো সঙ্কোচ কোনো ভয় কিচ্ছু নেই। ভোর হওয়ার একটু আগে আমারও খুব ঘুম পেলো। চেয়ারেই ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নিলাম। সকালে মৌসুমী জোর করে পাঠিয়ে দিল। এক রাত না ঘুমিয়ে আমারও শরীর খারাপ লাগছিল। কলেজে গেলাম না। দুপুরে ভাত খেয়েই শুয়ে পড়লাম।
রাত নটার সময় মামী ডেকে তুললেন। বললেন আমার জন্য নাকি ফোন এসেছিল। আমি তখন ঘুমিয়ে ছিলাম। আবার নাকি ফোন আসবে। কিন্তু অনেক সময় অপেক্ষা করার পরও ফোন এলো না। খবর এলো সকালে। কলেজে যাওয়ার জন্য সাইকেল উঠতে যাচ্ছি তখনই মামি ডেকে বললেন আমার জন্য ফোন। সুলতানা কল করেছে। দৌড়ে এসে ধরলাম। গতকাল সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ মৌসুমীর বাবা মারা গেছেন। অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্য! ফোন রেখে দাঁড়াতে পারছিলাম না। সশব্দে রিসিভার হাত থেকে পড়ে গেলো। কী হলো, কী হলো, বলে মামি দৌড়ে এলেন। জীবনের প্রথম কোন প্রিয় জনের কাছের মানুষের মৃত্যু! একটি কথাই মনে আসছিল, মৌসুমী কেঁদে কেঁদে নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে যাবে। কে সামলাবে ওকে!
মৌসুমীর বাবার জানাজায় যেতে পারলাম না। মৃত্যুর খবর পরের দিন পেয়েছিলাম আর উধারবন্দে ওদের বাড়ি কোথায় জানতাম না। বড় আফসোস হলো কিন্তু কিচ্ছু করার ছিল না। আজকালকার মতো মোবাইল থাকলে এমন অসহায় বোধ হতো না। এক গ্লানি আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আমি তো মৌসুমীর খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। ওর এত খারাপ সময়ে কাছে থাকতে না পারার অপরাধবোধে ভুগলাম দিনের পর দিন। মৌসুমী আর কলেজে এলো না।
আমি কলেজে যাই কিন্তু পড়াশোনায় মন বসে না। কয়েকবার ভাবলাম একদিন চলে যাই উধারবন্দ। খবর নিয়ে আসি কী করছে আমার পিতৃহারা মৌসুমী। কিন্তু কোথায় বাড়ি, কীভাবে যেতে হবে কিচ্ছু জানি না। সময় কাটতেই চায় না। ভাবতে থাকি একদিন আবার ওর জীবন রুটিনে ফিরে আসবে আর অপেক্ষা করতে থাকি। রোজ কলেজে যাওয়ার আগে স্বপ্ন দেখি আজ হয়তো কলেজে পৌঁছেই দেখবো, গেটের সামনে মৌসুমী দাঁড়িয়ে আছে। সেই পরিচিত, গালে টোল ফেলা একটুকরো রহস্যময় হাসি। কিন্তু নাহ্, ও আসা বন্ধ করে দিল।
প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে। মৌসুমী বোধহয় পড়াশোনা ছেড়েই দিয়েছে। ও বলছিল ওর বাবার কিছু হয়ে গেলে ওরা গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। একা মা আর ছোট বোনকে নিয়ে পাঁচগ্রামে থাকা সম্ভব হবে না। বাবার চাকরির জন্যই ওরা পাঁচগ্রামে থাকতো আর এজন্যই বদরপুর কলেজে ডিগ্রিতে এডমিশান নিয়েছিল। এখন হয়তো উধারবন্দের কোনো কলেজে পড়াশোনা করবে নইলে পড়াশোনা ছেড়ে দিতেও পারে। সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের সময় হয়ে এলো। আমি ভাঙ্গা মন নিয়ে ফর্ম ফিলাপ করলাম। মৌসুমী ফর্ম ফিলাপেও এলো না। নিশ্চয়ই এবার ও ড্রপ দেবে অথবা পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে ওর। আমার পরীক্ষা এবার আরও খারাপ হবে তা নিশ্চিত ছিল। দুই বছরে আমি মোট বিশ দিনও বই নিয়ে বসিনি।
যেমন ভেবেছিলাম তেমনই হলো। ফর্মালিটি হিসেবেই পরীক্ষায় বসলাম। দু-এক পেপার ছাড়া বাকি সব পেপারেই ফেল করব এটা নিশ্চিত ছিল। তবে পাস কোর্সের বিষয়গুলো মেজর থেকে অনেক সহজ ছিল। মৌসুমী পরীক্ষা দিলোনা। চার মাস হয়ে গেছে ও একদিনও কলেজে এলো না। শরীর মন সব খারাপ আমার। কোনোমতে পরীক্ষা দিয়েই বাড়ি চলে গেলাম।
ঠিক করলাম আর বদরপুরে যাবো না। গেলেই নিজেকে বড় একা মনে হয়। কলেজে গেলে অন্যমনস্ক থাকি। খাওয়া পরা ঘুরাফেরার বিলকুল ইচ্ছা হয় না। সময় কাটতে চায়না। গল্প কবিতা ম্যাগাজিনও পড়ে ক্ষণিকের জন্যও ওকে ভুলা যায় না। মৌসুমীর কথা ভাবলেই কান্না পায়। এক অসম্পূর্ণ উপাখ্যান। হুট করে আলাদা হয়ে গেলাম আমরা। ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনা করার আগেই চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। বড় নিষ্ঠুর আমাদের ভাগ্য।
মৌসুমীর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল হাসপাতালে। যখন ওর বাবা এডমিট ছিলেন। ওর বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে আমরা একে অন্যের থেকে দূরে চলে গেলাম। এর পর মৌসুমীর সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। ওর স্মৃতি বড় কষ্ট দিত। হাতে লেখা কয়েকখানা চিঠি, কয়েকটি কবিতা ছিল। একদিন বাড়িতে বস কাগজগুলো নাড়াচাড়া করছি তখন মা দেখতে পেলেন। সব বুঝে ফেললেন। কেঁদে কেঁদে বললাম মৌসুমীর কথা। মা বললেন এসব সাময়িক টান। কয়েকদিন পর কিচ্ছু মনে থাকবে না। মায়ের উপর রাগ করে চিঠি, হাতে লেখা কবিতা, কয়েকটি গ্রিটিং কার্ড সব জ্বালিয়ে ফেললাম। স্থির করলাম আর বদরপুরে যাবো না। আমার দ্বারা সেই একই কলেজে গিয়ে, কেন্টিনে, ক্লাসে বদরপুরের অলিগলিতে, সবজায়গায় থাকা স্মৃতির অত্যাচার সহ্য করা সম্ভব হবে না। পড়াশোনায় কোনদিনই মন লাগাতে পারব না।
ডিগ্রি কমপ্লিট হবে না সেটা বাবা ভাবতেই পারছিলেন না। মা নিশ্চয়ই বাবাকে সবকিছু খুলে বলেছিলেন। বাবা আমাকে বোঝাতে লাগলেন। মাত্র একবছর একটু মন দিয়ে পড়লেই ব্যাস। ডিগ্রি না হলে পড়াশোনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমার একই জেদ। আমি বদরপুরে যাব না। ঐ কলেজ ভাললাগে না আর। বাবা খবর নিয়ে দেখলেন যে ইউনিভার্সিটি থেকে ট্রান্সফার নেয়া যায় আর থার্ড ইয়ার অন্য কলেজ থেকে কমপ্লিট করা যায়।
আসাম ইউনিভার্সিটিতে আমাদের এক সম্পর্কিত নানা সেকসন অফিসার ছিলেন। বাবার পরামর্শ অনুযায়ী ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে নানার সঙ্গে দেখা করলাম। কাগজ পত্র জমা দিয়ে এলাম। নানা পরামর্শ দিলেন রামকৃষ্ণ নগর কলেজে যাওয়াই ভালো হবে। প্রিন্সিপালের সঙ্গে ওনার পরিচয় ছিল। আমার সামনেই ফোনে কথা বলে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ঠিক হলো রেজাল্ট হওয়ার পরই রামকৃষ্ণ নগরে চলে যাব। থার্ড ইয়ার ওখান থেকেই হবে।
কয়েকমাস বারইগ্রামে কাটালাম। সারাদিন ক্লাবে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। বিকেল ফুটবল আর রাতে কেরাম খেলা হতো রোজ। এরপর পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। সাঙ্ঘাতিক খারাপ। ফার্স্ট ইয়ারে দুটো ব্যাক ছিল, এবার আরও দুটি পেপারে ফেল। মোট চার চারটি ব্যাক। এরমানে থার্ড ইয়ারের নিয়মিত ছয়খানা আর ব্যাক চারখানা নিয়ে মোট দশ পেপার ক্লিয়ার করতে হবে। খুব কঠিন হবে কিন্তু করতেই হবে। যে পেপারগুলোয় পাশ করেছি তার এভারেজ পার্সেন্টেজ ৫০ এর একটু উপরে। তাই থার্ড ইয়ারে ভালো করে না পড়লে মেজর থাকবে না।
রেজাল্টের পর একদিন রামকৃষ্ণ নগর গেলাম। কলেজে কাগজপত্র জমা দিলাম। রামকৃষ্ণ নগর টাউন থেকে এক কিলোমিটার দুরে বালিরবন্দ গ্রামে ভাড়া ঘর পেয়ে গেলাম। রুমমেট ঈরালিগুলের একটি ছেলে। ও সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। গ্রামের এক বাড়ি থেকে মাসিক টাকার বিনিময়ে টিফিনের ব্যবস্থা হলো। বালিরবন্দের ছেলে হুসেইন সব ব্যবস্থা করে দিল। আমার জীবনে এরকম অনেক হুসেইন আছেন আর আগামীতেও আসবেন যারা প্রয়োজন হলেই কোথা বেরিয়ে আসেন, সে আমার অজপাড়া গ্রাম হোক আর দেশে বিদেশে কোনো অচেনা শহরেই হোক। যেখানেই গিয়েছি অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে আর আজও তাঁরা আমার হৃদয়ে আছেন। হুসেইন তাদের মধ্যে অন্যতম। লেখাপড়া না করা, খেটে খাওয়া হুসেইনের সঙ্গে আজও আমার গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে।
কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার পর আমাদের ডিপার্টমেন্টের দুজনের সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হলো। ত্রিপুরার শহিদ মজুমদার আর রামকৃষ্ণ নগরের সুদীপ্ত। খুব আনন্দে দিন রাত পড়াশোনা করে থার্ড ইয়ার কমপ্লিট হলো। শহিদের সঙ্গে পড়াশোনা থেকে শুরু করে সাহিত্য, কবিতা লেখালেখি ইত্যাদি নিয়ে দিনরাত আড্ডা হতো। রামকৃষ্ণ নগর কলেজের ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতিতে খুবই সক্রিয় থাকত। আমি নিজেকে একটিভ পলিটিক্স থেকে সরিয়ে রাখতাম। পড়াশোনার প্রতি খুব মনোযোগী হলাম। বন্ধ হলেই জামাতে যেতাম। ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করার অভ্যাসও তখন থেকে গড়ে উঠে।
রেজাল্টের দিন মার্কশিট দেখে চোখে জল। সব পেপার ক্লিয়ার। পার্সেন্টেজ ও খারাপ না। তিন বছরের কলেজ জীবন শেষ হলো। তবে এক অসম্পূর্ণ সম্পর্কের স্মৃতি মাঝে মাঝে উকি দিত। ভাবতাম পুরনো দিনগুলো ভুলে যেতে হবে। ধীরে ধীরে সব মন থেকে মিলিয়ে গেল। কিন্তু এখনও ভালোবাসা বাকি ছিল। আমি যখন ডিগ্রি পাস করি তখন আমার আগত দিনের প্রেয়সী গুয়াহাটির এক হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেছে। পরিচয় হলো ছয়মাস পর।
ডিগ্রির রেজাল্টের পর মাস্টার্স ডিগ্রি কোথায় করব তা নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা হলো। আমার রেগুলার কোর্স করার ইচ্ছা ছিলনা। ঠিক করলাম ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটিতেই এমএ করব। একাডেমিক সেশন শুরু হওয়ার তখনও ছয়মাস ছিল। ভাবলাম এই কদিন এমনি এমনি বাড়িতে না থেকে কম্পিউটার শিখি। তখন করিমগঞ্জ স্টিমার ঘাট রোডে নতুন কম্পিউটার কোচিং সেন্টার চালু হয়েছে। সফটওয়্যার টেকনোলজি গ্রুপ ইন্টারনেশনাল লিমিটেড। একদিন ইনকোয়ারি করতে গেলাম। সেন্টার কোঅর্ডিনেটর মণিদীপা রায় কম্পিউটার শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অনেক বোঝালেন। কিন্তু ফিজ অনেক বেশি। এক বছরের ডিপ্লোমা কোর্সে দিতে হবে ২৭০০০ টাকা। বাবা রাজি হলেন না। বললেন বর্তমানে এতো টাকা নেই। তাই বাদ দিলাম।
কয়েকদিন পর স্টিমার ঘাট রোড দিয়ে যাচ্ছি। দেখি সেন্টারের সামনে স্কলারশিপ পরীক্ষার বিজ্ঞাপন লাগানো আছে। ভেতরে গিয়ে মণিদীপা ম্যাডামকে স্কলারশিপ পরীক্ষার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন পরীক্ষার কোনো ফিজ লাগবে না। প্রাপ্ত মার্কের উপর ভিত্তি করে এডমিশান ফিজের উপর ডিসকাউন্ট দেয়া হবে। পরীক্ষা দিলাম। সাধারণ জ্ঞান আর ইংরেজি ভাষার উপর টেস্ট। ৭০% মার্ক পেলাম। একখানা সার্টিফিকেট আর ৫০% ডিসকাউন্ট ক্যুপন দেয়া হলো। বাবা মেনে নিলেন। এককালীন ১৩৫০০ টাকা জমা দিয়ে এডমিশান নিলাম।
সপ্তাহে তিন দিন দুঘন্টা করে ক্লাস। তখন উইন্ডোজ ১৯৯৮ ছিল। খুব শীঘ্রই ওয়ার্ড, পাওয়ারপয়েন্ট, এক্সেল ইত্যাদি শিখে নিলাম। আমাদের ব্যাচে ছয়জন ছিলেন। আমার পারফরম্যান্স সবচেয়ে ভালো ছিল। মাইক্রোসফট অফিস শেষ হওয়ার পর শিখলাম জাভা, এইচটিএমএল, এএসপি ইত্যাদি। ছয়মাসের মধ্যে ল্যাংগুয়েজের ক্লাস শুরু হলো। সি, সি প্লাস প্লাস ইত্যাদি দিয়ে ছোট ছোট প্রগ্রাম বানাতে খুব ভালো লাগতো। আমাদের ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন শিলচরের এক ভদ্রলোক। নাম মনে নেই। খুব সিগারেট খেতেন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ওনার সুবাদে ক্লাস শেষ হওয়ার পরও অতিরিক্ত সময় বসে প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেতাম। মনে আছে একদিন ওনার সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট চুরি করে নিয়েছিলাম। তখন মাঝে মাঝে সিগারেট খেতাম।
ছয়মাসে কম্পিউটার দুনিয়ার অনেক কিছু আয়ত্ত করলাম। এর পর এলো ইউনিভার্সিটির এডমিশান। বাবা আমাকে নিয়ে গুয়াহাটি রিজিওনাল সেন্টারে গেলেন। সেটাই আমার প্রথমবারের নাইট সুপারে গুয়াহাটি যাওয়া। এর আগে কয়েকবার গেছি কিন্তু ট্রেনে। তখনও লামডিং থেকে গুয়াহাটি অবধি মিটারগজ ট্রেইন চলতো। ধর্মনগর থেকে গুয়াহাটি অবধি ডাইরেক্ট ট্রেন ছিল পাহাড় লাইন এক্সপ্রেস। এবার প্রথম বার করিমগঞ্জ থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার জন্য নাইটসুপারে যাত্রা করলাম। রাস্তায় কালাইনে নেমে রাতের খাবার খেলাম। সুস্বাদু নিরামিষ খাবার। আজকাল করিমগঞ্জ গুয়াহাটি লাইনে অসংখ্য হোটেল, ধাবা, রেস্তোরাঁ হয়েছে কিন্তু আগের মতো সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায় না। বাইরে বড় বড় সাইনবোর্ড থাকে কিন্তু খাবার এত অখাদ্য যে মুখে দেয়া যায় না। কাস্টমার সার্ভিসেও এখনকার লাইন হোটেলগুলো জিরো মার্ক পাবে।
সাত সকালে গুয়াহাটি পৌঁছে গেলাম। তখন বাবার পোস্টিং নুনমাটিতে ছিল। কেম্পে থাকলাম দুদিন। ইগ্নুর রিজিওনাল সেন্টারে গিয়ে এডমিশান নিলাম। আমার স্টাডি সেন্টার গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ল। ডিসটেন্স লার্নিংয়ে ইংরেজি সাহিত্যে দুই বছরের মাস্টার ডিগ্রি। এডমিশান নিয়ে চলে গেলাম মামার বাড়ি।
আমার মামার বাড়ি বরপেটা জেলার সরুপেটা নামক ছোট্ট একটি টাউনে। মা অসমিয়া, বাবা বাঙালি। আমার মা-বাবার বিয়ে মানে লাভ কাম এরেঞ্জ মেরেজ। মাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম আর এখনও করি কিভাবে কি হলো। কিন্তু আমার মা এখনও ওদের বিয়ের প্রসঙ্গ আনলে লজ্জায় লাল হয়ে যান। যতটুকু তথ্য উদ্ধার করতে পেরেছি তার উপর নির্ভর করে বলা যায় বাবা প্রথমবার মাকে দেখেই পছন্দ করেছিলেন। কিভাবে দেখা হলো তা আজ সংক্ষেপে বলে দিচ্ছি। পরে এনিয়ে আরেক ধারাবাহিক লেখা যেতে পারে যদি পাঠকদের আগ্রহ হয়। তবে মার কাছ থেকে অনুমতি আর আরও ডিটেইলস লাগবে।
বাবা তখন ইস্টার্ন কমান্ডে নিযুক্ত ছিলেন। বিধির লেখা ছিল তাই পোস্টিং হলো নলবাড়ি জেলার টিহু কেম্পে। একদিন বাজারের মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে পরিচয় হলো সরুপেটার নুরুল হকের সঙ্গে। নুরুল হক আমার মেজো মামা। কয়েকদিনের মধ্যেই ঈদ আসছিল। মামা বাবাকে ঈদের দাওয়াত দিলেন। সেখানেই মার সঙ্গে বাবার দেখা। মা তখন ক্লাস নাইনে পড়তেন। বাবার পছন্দ হওয়ায় প্রথম দেখার দিনই বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। মামাদের পরিবার মানলেন না। তখন আমার নানা নানী জীবিত ছিলেন। বিয়ের প্রস্তাব নাকচ হলেও বাবার সঙ্গে নুরুল মামার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে গেল। ইতিমধ্যে মা মেট্রিক পাস করলেন। বাবা আমাদের বাড়ির সবার সঙ্গে আলোচনা করে অনুমতি নিয়েই আরেকবার বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। এবার মা নাকচ করলেন। একমাত্র নুরুল মামা ছাড়া কেউ চাইতেন না কাছাড়ের এক বাঙালি পরিবারের ছেলের সঙ্গে আমার সতেরো বছরের অসমিয়া মায়ের বিয়ে হোক।
অনেক টানাপোড়েনের পর আমার নানার গোষ্ঠী মায়ের বিয়ের জন্য রাজি হলেন। এর আগে তন্ন তন্ন করে আমাদের করিমগঞ্জের বাড়ির খবর নিলেন। নুরুল মামা ওনার বন্ধুকে নিয়ে এসে আমাদের ঘরবাড়ি দেখে গেলেন। অবশ্য উনি বাবার বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন তাই কোনো সমস্যা হলো না। মার বয়স আঠারো হওয়ার পর বাবার সাথে বিয়ে হয়ে গেল। বাবা তখন কেম্পে থাকতেন। নলবাড়ি জেলার টিহুতে একটি ঘর ভাড়া করে শুরু হলো পরিবার। বিয়ের তিন বছর পর আমার জন্ম টিহু সিভিল হাসপাতালে। আমি প্রি-মেচিউর চাইল্ড। মানে মাত্র সাড়ে সাত মাস মায়ের পেটে থাকার পর আমার জন্ম হয়।
আমার জন্মের কয়েক মাস আগে নানা মারা জান। একদিন সকালে ধান কাটতে যাচ্ছিলেন। ভোরের আলো তখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। গ্রাম থেকে আধ কিলোমিটার দুরে ন্যাশনাল হাইওয়ে পার হয়ে ক্ষেতের জমিতে যেতে হয়। কুয়াশায় ঢাকা রাস্তা পার হওয়ার সময় সজোরে ধেয়ে আসা ট্রাকের ধাক্কায় নানার মৃত্যু হয়। সেদিন বুধবার ছিল। আমার নানীও বেশিদিন বাঁচেননি। আমার জন্মের ছয়মাস পর নানী আমাকে টিহুতে দেখতে আসার সময় রাস্তায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সেদিনও বুধবার ছিল। আমার জন্মের বারও বুধবার। এসব আমার মায়ের মুখে শোনা কথা। আমার ছয় মামা আর দুই মাসি। ঈশ্বরের কৃপায় এখনও মামা মাসি সবাই জীবিত আছেন।
আমার বয়স তখনও এক বছর হয়নি। করিমগঞ্জের বাড়িতে বাস্তুজমি নিয়ে কিছু সমস্যা হওয়ায় বাবা আমাদেরকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এনে সেটেল করলেন। এর পর কয়েকবার বাবার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গার সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারে গিয়ে মা আর আমি থেকেছি। কিন্তু ছোটভাইয়ের জন্মের পর পাকাপাকি ভাবে আমরা বারইগ্রামে থাকি। আমার আর ছোট ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান সাড়ে তিন বছর।
ছোট থাকতে অনেক বার মা বাবার সঙ্গে বরপেটায় মামার বাড়িতে গিয়েছি কিন্তু বেশিরভাগ স্মৃতি অস্পষ্ট। ক্লাস ফাইভের পর আর একবারও যাওয়া হয়নি। তাই প্রায় নয় বছর পর মামার বাড়ি যাওয়া অনেক আনন্দের ব্যাপার ছিল। মনে হচ্ছিল এক নতুন জায়গায় যাচ্ছি। গুয়াহাটি থেকে বরপেটা যাওয়া বাসে বসে আমার জন্মস্থান আর রক্তের সম্পর্ক থাকা প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করার রোমাঞ্চ কল্পনা করে আপ্লুত ছিলাম। আমার মামা মাসি আর আশপাশের আত্মীয় স্বজনদের ছেলে মেয়ে বেশিরভাগ আমার বয়সের। আমার কাছে এক এডভেঞ্চার লাগছিল। তখনও ভালো করে অসমীয়া বলতে পারি না। আমার মা আমাদের সঙ্গে থেকে থেকে সিলেটি হয়ে গেলেন কিন্তু আমরা দুই ভাই অসমীয়া হতে পারলাম না।
গুয়াহাটি থেকে বরপেটা যাওয়ার রাস্তা ছবির মতো সুন্দর। ছিমছাম প্রশস্ত জাতীয় সড়ক সাপের মতো এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে। যেন ন্যাচারাল সিনারির একখানা পোস্টকার্ড। একশ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তার দুপাশে একের পর এক সবুজ গাছপালার সারি। শীতের মরসুম। বাসের জানালা খুললেই শরীর মন স্নিগ্ধ করা বাতাস যেন ঘুম লাগিয়ে দেবে। কোনোমতে রঙ্গিয়া পার হলেই দেখা যাবে ধান কাটার সময়ের পরবর্তী সোনালী প্রান্তর। মাইলের পর মাইল ফাঁকা মাঠ যেন অনেক দূরে গিয়ে আকাশের সঙ্গে মিলে গেছে।
বাস যখনই ছোট খাটো স্টপেজে থামবে তখনই হকাররা জানালা ঘীরে ধরবে। স্থানীয় অসমীয়া বিক্রেতারা টিপিক্যাল অসমীয়া উচ্চারণে হাকাহাকি শুরু করে দেবে। খাবার দাবার, পান, সিগারেট, বাদাম ইত্যাদি ছাড়াও অবশ্যই থাকবে অসমীয়া খাদ্য সম্ভার। গুয়াহাটি থেকে নিম্ন আসামের দিকে বাসে গেলে বাস যেখানেই থামবে শুনতে পাবেন 'পানি বতল' (জলের বোতল), 'টেঙা ছকলেট (কমলার খোসার মতো ডিজাইনের একধরনের টক চকলেট, সম্ভবত অসমীয়াদের জাতীয় চকলেট)', 'বুট ভাজা'( চানাচুর) গাখীর ছা (দুধের চা), 'টেকলি পিথা' (চালের গুড়ো আর গুঁড় দিয়ে নির্মিত অসমিয়া পিঠে) আরও কত কি। এই টেকলি পিঠা আমার সহ্য হয়না।
নলবাড়ির পাশাপাশি চলে এলেই রাস্তার দুপাশে শুরু হয়ে যায় সর্ষে ফুলের মাঠ। শীতকালে অসমীয়া কৃষক যাদের জমিজমা বেশি তারা সর্ষে চাষ করে। বাসের জানালা খুলে দিলেই দুর থেকে দুরে হলদে রঙের বিছানো চাঁদর মনে হয়। যেন শেষ হতে চায়না। ছবি তুলার জন্য খুব ভালো স্পট।
এরপর আসবে পাঠশালা। নিম্ন আসামের শিক্ষা ক্ষেত্রে বিখ্যাত স্থান। অসংখ্য নামিদামি স্কুল, কলেজ, হোস্টেলে ছয়লাপ ছোট্ট শহর পাঠশালা। মাধ্যমিক হোক বা উচ্চ মাধ্যমিক পাঠশালার স্কুলে কলেজের ছেলেমেয়েরা টপ টেনে আসবে না এ হতেই পারে না। পড়াশোনার ক্ষেত্রে থাকা এই ঐতিহ্যের সাথে বরপেটা জেলার এই শহরের নামকরণ পাঠশালা সত্যিই সার্থক হয়েছে। শিক্ষা সংস্কৃতির দিকে অনেক এগিয়ে থাকলেও স্থানীয় লোকেরা কিন্তু আজও ততটা বিত্তশালী নন। বেশিরভাগ পড়ুয়া বাইরে থেকে এসে পাঠশালার স্কুল কলেজে পড়াশোনা করে। পাঠশালার স্থানীয় সাপ্তাহিক বাজারও নামকরা। দুর দুরান্তের গ্রাম থেকে ফসল নিয়ে কৃষক ব্যবসায়ী আর খদ্দের এই সাপ্তাহিক বাজারে আসেন।
এই পাঠশালা থেকে জাতীয় সড়ক হয়ে দশ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই সরুপেটা ব্লক। সরুপেটা অন্তর্গত ছবির মতো এক ছোট্ট গ্রাম কহরা। আমার মামার বাড়ি। আসামে আর কোনো গ্রাম এত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গাছপালায় ঘন সবুজ অন্তত আমি দেখিনি। ছোটবেলা অসমীয়া কবিতা পড়েছিলাম "শুওনি আমার গাঁও খানি অতি...."। কহরায় গেলেই মনে হবে কবি যেন এই গ্রাম দেখেই কবিতাখানি লিখে ফেলেছেন।
এখন বাইপাস হয়ে গেছে তাই সরুপেটায় বাস যায়না। লং ডিসটেন্স গাড়িগুলো পাঠশালা থেকে ভবানিপুর হয়ে বরপেটা বা বঙ্গাইগাঁও চলে যায়। আমার মামার বাড়ি পৌঁছতে হলে নামতে হবে কহরা চারিআলিতে। চারিআলি মানে চৌরাস্তা। হাইওয়ে থেকে পাঁচ মিনিটের পায়ে হাঁটা দুরত্বে কহরা গাঁও।
হাইওয়েতে বাস থেকে নেমে দেখি গ্রামের প্রায় অর্ধেক লোক আমাদেরকে এগিয়ে নিতে এসেছেন। প্রায় সাত আট বছর পর কারুর "ভাগীন" কারুর "ককাই" কারুর "দাদা" শরীফ আসছে কাছাড় থেকে এটা যেন অনেক বড় ব্যাপার। আমি তো মামাদের ছাড়া কাউকে চিনি না। মেজ মামা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার মামা আর মাসিদের ছেলে মেয়েরা বেশিরভাগ আমার বয়সের। সবাই আমাকে এমনভাবে দেখছিল যেন আমি আরেক গ্রহ থেকে এসেছি।
বাবা আমাকে মামার বাড়িতে রেখে দিল্লি চলে গেলেন ডিউটি জয়েন করতে। আমি থাকলাম একমাস। কহরায় গিয়ে জানতে পারলাম আমার মায়ের এক খুব ভালো বান্ধবী আছেন। ছোটবেলা আমাকে খুব আদর করতেন কিন্তু আমার কিচ্ছু মনে নেই। আমি 'মাহি' বলে ডাকতাম। আমার মামাতো ভাইয়েরা এক অদ্ভুত খবর দিল। ঐ মাসির ছোট মেয়ের সঙ্গে নাকি আমার বিয়ে হবে। আমার মা বাবা আর ওর মা বাবা নাকি এনিয়ে প্রায়ই বলাবলি করেন। মেসো বাবার মতো সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। আমি এসব শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। এসব কি আমার কাজিনরা ফাজলামো করছে না সত্যিই কোনো সিরিয়াস আলোচনা হয়েছে জানতাম না। তবে খুব কৌতুহল হল ওকে দেখার। কে ঐ মেয়েটি?
Comments
Post a Comment