স্মৃতিচারণ : আসছে ঈদ
আসামের এক প্রান্তিক গ্রামে আমাদের বাড়ি। বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। তখন আমার বয়স সবে বারো বছর। গ্রামের স্কুলেই সপ্তম শ্রেণীতে পড়তাম। ঐ বছরের ঈদ ছিল গরমের ছুটির মাঝামাঝি। এবার বাবা ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসছেন। এর থেকে আর আনন্দের কি হতে পারে যখন ঈদের সময় বাবা বাড়ি আসবেন। উনি মধ্যপ্রদেশের নীমাচে থাকতেন। সেনাবাহিনীর ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষক ছিলেন। কোন জরুরী কাজ না থাকলে বছরে এক বারই ছুটি আসা হতো। তাই সারা বছর আমরা ক্যেলেন্ডারে হিসাব করতে থাকতাম - আর ক'দিন পর বাবা আসবেন। এবার আকস্মিকভাবে ওনার ছুটি মঞ্জুর হয়ে যায়। বছর ঘুরে আসার আগেই আবার বাড়ি আসছেন বাবা। আমার তো খুশির সীমা ছিল না।
খবর তখন পেলাম যখন বাবা ইতিমধ্যে ট্রেনে চড়েছেন। দুদিন পরই পৌঁছে যাবেন। মা খুব ব্যস্ত হয়ে গেলেন। সাফ সাফাই, ঈদের আয়োজন সব করতে হবে। আমিও মাকে যথারীতি সাহায্য করা শুরু করলাম। আমার একটিই ছোট ভাই। ওর বয়স তখন আট বছর।
প্রতি বছর ঈদে কিন্তু আমরা নতুন জামা কাপড় পেতাম না। বাবা বাড়িতে না থাকলে সবাই মন মরা হয়ে থাকতাম। মা বাজারে গিয়ে কিনে দেবেন এমন সুবিধাও সবসময় হয়ে উঠতো না। ঐ বয়সেও বোঝতে পারতাম মা'র ও মন ভালো নেই। আমরা একা থাকতাম। বাড়িতে বাবা না থাকলে সবসময় সব সুবিধা হয়ে উঠে না। তাই ছোটবেলা থেকেই আমি খুব একটা আবদার করতাম না। পরিবারের সুবিধা অসুবিধা বোঝতে পারতাম। সময়ের সাথে মানিয়ে নিতাম। তবে এবারের ঈদ কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল। আমি জানতাম বাবা নিশ্চয়ই অনেক জিনিস কিনে দেবেন। নতুন পাঞ্জাবি আর জুতো আমার লাগবেই। জানি না, হয়তো সব সঙ্গে করে নিয়েই আসছেন। মা যখন নীল রঙের ইনলেন্ড লেটারে বাবাকে চিঠি লিখতেন তখন আমি মনে করিয়ে দিতাম। ঈদের জন্য পাঞ্জাবি, নতুন জুতো, বেডমিনটন রেকেট, টি-শার্ট আর পেন্ট। এসব তো লাগবেই। আর মাত্র দু'দিন। সব পেয়ে যাবো।
অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এলো। আমার খুড়তুতো ভাই আর আমি বাবাকে রিসিভ করতে স্টেশনে গেলাম। যখনই দেখলাম বাবা ট্রেনের কামরা থেকে নেমে আসছেন, আমি এক দৌড়ে ওনার কাছে চলে গেলাম। উনি আমাকে কোলে তুলে নিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই তো বড়ো হয়ে গেলি! ওনার সঙ্গে দুটো বড় ব্যাগ ছিল। আমরা ব্যাগ গুলো নিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে রিকশায় চড়লাম। রাস্তায় বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম আমার জুতো এনেছেন কি না। আর বাকি সব, যা মা চিঠিতে লিখে দিয়েছিলেন, সেগুলো তো এনেছেন? উনি কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। অনেক পিড়াপিড়ি করার পর বললেন আমরা বাজারে গিয়ে এইবার ঈদের কাপড়চোপড় কিনব। আমি কিছুটা দূঃখিত হলেও আশ্বস্ত ছিলাম। নিশ্চয়ই আমার চাওয়া সবকিছু বাবা বাজার থেকেই কিনে দেবেন।
পরের সপ্তাহে ঈদ। ঈদের আগের দিন দুপুর বেলা বাবা আর আমি বাজারে রওয়ানা হলাম। মা এলেন না। ছোট ভাই বাজারে এলে খুব ঝামেলা করে আর অন্য দিকে ঈদের জন্য অনেক খাবার বানাতে হবে। বাবা ছুটি কাটাতে এসেছেন তাই ঈদের দিন আমাদের ঘরে অনেক আত্মীয় স্বজন দেখা করতে আসবেন। রাস্তায় বাবা আমার সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। তিনি বললেন আমার তো অনেক কাপড় আছে। দুজুড়ো জুতো তো আছেই যা এখনও খারাপ হয়নি। বাবা বাড়িতে না থাকলেও প্রয়োজনীয় জিনিস মা ঠিকই কিনে দেয়। আমার কি কাপড়ের কি কোনো অভাব আছে? বাবার কথা মানতে হলো। নতুন জামা আর জুতো না থাকলেও পর্যাপ্ত পরিমাণে সব আছে। বাবা বললেন আমাদের চারপাশে অনেক পরিবার আছে। অনেক বাড়ির ছেলে মেয়েরা বছরের পর বছর কিচ্ছু কিনতে পারে না। ওরা এত দরিদ্র যে জুতো ছাড়াই স্কুলে যায়। দুবেলা ভালো করে খাওয়া জুটে না। ওদের কথা কি আমরা ভাবি? বাবা এই প্রশ্ন করে আমার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন এবার থেকে ঈদে আমরা এত বেশি জিনিস না কিনে কিছু টাকা বাঁচাব। আর ঐ টাকা দিয়ে প্রতি বছর আমাদের আসপাশের দরিদ্র ছেলেমেয়েদেরকে কাপড় বা জুতো কিনে দেব, যাতে ওরাও আমাদের সাথে ঈদের আনন্দে যোগ দিতে পারে। বাবা এবার থামলেন আর আমার দিকে তাকালেন। যেন আমার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি বোঝতে পারলাম যে আমাকে এবার সবকিছু দেয়া হবে না। মন খারাপ হয়ে গেলো। বাবা বুঝতে পারলেন। আমাকে কোলে টেনে নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন আমার ইচ্ছা কি। আমি কিচ্ছু বললাম না। বাবার যুক্তি ঠিকই ছিল। নতুন জুতো বোধহয় এবার পাওয়া যাবে না।
বাজারে গিয়ে বাবা আমাকে জুতো আর পাঞ্জাবি সহ সবকিছুই কিনে দিলেন। জমানো টাকা থেকে উনি আরও কিছু কাপড় কিনে নিলেন। বাড়িতে এসে আছরের নামাজের পর আমরা আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি পরিবারের ছেলেমেয়েদেরকে ঐ কাপড়গুলো দিয়ে এলাম। ওরা খুব খুশি হলো। আমারও ভালো লাগলো। এ এক আলাদা খুশি বোঝতে পারলাম। ঐ বছরের ঈদে খুব আনন্দ হলো। নিজের অংশ থেকে অন্যকে দেয়ার স্বাদ পেলাম সেই বারো বছর বয়সে।
বাবা আমাদেরকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার বারো বছর হয়ে গেছে। কিন্তু আমি সেই দিনের কথা ভুলতে পারি না যখন তিনি আমার মনে অন্যদের জন্য চিন্তা করার একটি স্বতন্ত্র বীজ বপন করে গিয়েছিলেন। অত্যন্ত কম বয়সে মানবতার এই পাঠ দেয়ার জন্য আমি আমার বাবার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। প্রতি বছর ঈদের সময় বাবার কথা খুব মনে পড়ে। আর ঈদের শপিংয়ে নিজের জামাকাপড় ছাড়া সামান্য হলেও অতিরিক্ত কাপড় কিনে নেই যাতে আমার সাথে অরও কয়েকজনের মুখে আনন্দের হাসি দেখতে পাই।
-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+
নেট ফড়িং অনলাইন ম্যাগাজিনের বিশেষ ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত |
Comments
Post a Comment