বিদেশের পথে
চাকরি জীবন আসলেই বোরিং হয়ে গেছে। একঘেয়ে, স্বাদহীন দশটা পাঁচটা বিরক্তিকর হতে সময় লাগলো মাত্র দু'বছর। আগের দুটো কোম্পানিও প্রথমে খারাপ লাখতো না। কিন্তু মুম্বাইর মতো শহরে মাত্র বিশ একুশ মাসেই বিরক্ত হয়ে পড়ব জানতাম না। সব আছে কিন্তু নতুনত্ব কই। বড় অঙ্কের বেতন, অতিরিক্ত পার্কস, আর স্বাধীন ভাবে কাজ করার জন্যই এই চাকরির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। দরকার তো ছিলই। নইলে কতবার নিজেকে বলা হয়ে গেছে - আর নয়, এবার ব্যবসা করব। কিন্তু শেষমেশ কি হলো! বোর্ড অব ডিরেক্টরস মিটিংয়ে আমার আইডিয়া শুনে সবাই তালি বাজায় ঠিকই কিন্তু কখনও নতুন প্ল্যান রুপান্তরিত হতে দেয়া হয় না। পরিবর্তন কেউ চায় না। আসল কারণ, নতুন একজন যে হুট করে এসে উপরে উঠে যাবে তা কেন হবে? এই রেষারেষি সভ্যতার ইতিহাস থেকেও পুরনো। এই ট্রেডিসন সর্বত্র। সত্য নাডেলা হোন বা সুন্দর পীচাই, কর্পোরেট জগতে উপরে উঠার সিঁড়ি সবার কাছেই একই ভাবে কন্টকাকীর্ণ ও বিষধর। সিঁড়ির সাথে সাপ তো থাকবেই।
আরম্ভ ভালোই ছিল। কোম্পানির মালিকের মার্কেটিং এসিস্ট্যান্ট হওয়া শুনতে বেশ লাগে। যেমন ভেবেছিলাম প্রথম দিকে তেমনই ছিল মোটামুটি। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমার ধারণা ভুল। এরাও সেই ঘরানার। তুমি মজুরদের মতো খেটে যাও আর কম্প্রোমাইজ করে সবার সাথে সম্পর্ক রাখো কিন্তু কোন নতুন আইডিয়া চলবে না। একে একে ইট লাগিয়ে চলো কিন্তু একদিন হঠাৎ করে ভুমিকম্প এসে সব তছনছ করে দেবে। আচ্ছা, মানুষ কেন বদলে না? কেনো পুরাতনকে আঁকড়ে থাকতে চায়?
আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া আমার কাছে সমস্যা ছিল না। সাত আট বছর তো এমনই অডিও প্লেয়ারে কেসেট পাল্টে দেয়ার মতো রং বদল করতে করতে কাটিয়ে দিলাম। সময় আর সুযোগ বুঝে নিজেকে বদলে ফেলা জলভাত হয়ে গেছে সেই গান্ধী নগরের পরই। কর্পোরেট জগতের ইঁদুর দৌড় শেখার জন্য কল সেন্টার আজকের প্রজন্মের কারিগরি শিক্ষা হীন যুবকদের জন্য অদ্বিতীয় স্থান। আমারও এই মন্ত্র শিখতে দেরি হয় নি। সময় আর মানসিকতা বুঝে ফেললেই অপরের প্রিয় পাত্র হতে সময় লাগে না।
শুরুতেই দেখলাম কোম্পানির নীতি নির্দেশনায় অনেক খামখেয়ালীপনা স্থান পেয়েছে। একে একে বসকে রিপোর্ট করতে লাগলাম। অনেক পরিবর্তন এলো। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল সময়ানুবর্তিতা। অফিসে কেউ নির্ধারিত সময়ে আসবে না। আর দেরি হওয়ার জন্য রোজকার কাজ শেষ হয় না। কিন্তু কাজ তো শেষ করতেই হবে নইলে পারফরম্যান্স নিম্নগামী হয়ে যাবে। অফিস টাইম শেষ হওয়ার পরও কর্মীরা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকাকে অভ্যেস করে ফেলেছেন। এই কালচার আমার সহ্য হয় না। গান্ধী নগর আর আহমেদাবাদে যে দুই কোম্পানিতে চাকরি করেছিলাম সেগুলো ছিল পুরোদস্তুর প্রফেশনাল। ডিরেক্টর হোন বা সাধারণ একজিকিউটিভ, সময়ে আসবেন আর নির্ধারিত সিফ্টের ভেতরে কাজ শেষ করে যাবেন। উইকেন্ডে কোন ঝামেলা নেই। কোন ক্লায়েন্টের উটকো কল ও আসবে না আর ম্যানেজাররাও যন্ত্রণা দেবে না। আমাদের ভারতিয় বেসরকারি কোম্পানীগুলিকে আরও প্রফেশনাল হওয়া চাই। অন্তত সময়ের মূল্য দেয়া উচিত। নইলে আমেরিকা ইউরোপের সঙ্গে পাল্লা দেয়া সম্ভব হবে না।
মুম্বাইয়ের চাকরি অনেকটা ভাগ্যের পরিহাস হিসেবে গ্রহন করতে হয়েছে। দু বছর আগে গুজরাট ছাড়ার কারণ ছিল চাকরি না করা। মোটামুটি ভালোই টাকা জমিয়ে ফেলেছিলাম। প্ল্যান করলাম ব্যবসা করবো। আসামে আমার এক দূর সম্পর্কের বোনের স্বামী স্ক্র্যাপ ডিলারের কাজ করেন। উনাকে আমি ভাই সাহেব বলে ডাকতাম। আমাকে ছোটবেলা থেকেই খুব স্নেহ করতেন। উনার সঙ্গে কথা হলো। স্ক্র্যাপের ব্যবসা মানে সংক্ষেপে পুরনো লোহা, প্লাস্টিক, এলুমিনিয়াম, স্টিল ইত্যাদি গ্রামে গঞ্জে এজেন্ট লাগিয়ে কম দামে ক্রয় করা আর কারখানায় বিক্রি করে দেয়া। মোটামুটি মাসে যদি পাঁচ লাখ টাকার পুরনো লোহা কিনে কারখানায় বিক্রি করে দেয়া হয় তবে তিরিশ চল্লিশ হাজার টাকা লাভ বেরোয়। কিছু রিস্ক আছে যেমন সব সময় কারখানায় ভালো দাম পাওয়া যাবে না বা কখনও বন্যা কিংবা অন্যান্য কারণে স্ক্র্যাপ জমা নাও হতে পারে। তবে এতে সাধারণত লাভের অংশ কম হয়ে যায়। লোকসান হওয়ার ঝুঁকি খুব কম। উনি আমাকে ওর ব্যবসায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ করলেন। বললেন ব্যবসা ভালোই চলছে। দুজন হলে আরো ভালো। ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়ানো যাবে। আইডিয়া মন্দ নয়। ভাই সাহেবের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আমরা পার্টনার হিসেবে কাজ করবো বলে ঠিক হলো। উনার ইতিমধ্যে দশ লাখ টাকা ব্যবসায় খাটানো হয়ে গেছে। পঞ্চাশ শতাংশ পার্টনার হওয়ার জন্য আমাকে আরও দশ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। ভাই সাহেব থাকেন বরপেটা জেলার পাটাচারকুচি গ্রামে। কয়েকবছর আগে উনি ওখানেই জমি কিনে বাড়ি করে ফেলেছেন। বাড়ির সামনে গোদাম বানানো হয়ে গেছে। ঠিক হলো আমি উনার সাথেই থাকবো। যথেষ্ট অতিরিক্ত রুম আছে, তাই অসুবিধা হবে না। দিদিও আমাকে খুব স্নেহ করেন। এক ছেলে এক মেয়ের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। আমিও ভাবলাম অসুবিধে হবে না। ওদের সঙ্গে আনন্দেই থাকতে পারবো আশাকরি।
সব পরিকল্পনা হয়ে যাওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিলাম। গুজরাট থেকে পেকার্স এন্ড মোভার্স কোম্পানি আমাদের ঘরোয়া সব জিনিস এনে দিল। আহমেদাবাদে পরিবার নিয়ে থাকতাম। ২০১৪ সালের জুন মাসে শুরু হলো নতুন ব্যবসা। আপাতত পরিবারের সবাইকে করিমগঞ্জের বাড়িতে ছেড়ে এলাম। প্ল্যান ছিল ব্যবসা ভালো করে জমে উঠলেই ওদেরকেও নিয়ে আসবো।
ব্যবসা যত সহজ ভাবা যায় আসলে ততটা সহজ নয়। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা মাথায় ঘুরঘুর করে থাকে যত্তসব প্লাস মায়নাস। দুশ্চিন্তাতো থাকেই, সঙ্গে সবসময় আরও কিছু করা যায় কি না সেটাও ভেবে থাকতে হয়। জিম কলিন্সের বই গুড টু গ্রেডে লেখা আছে বড় কোম্পানি কিভাবে সবসময় উদ্ভাবন করে না থাকলে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায়। চরম প্রতিযোগিতার যুগে নতুনত্ব না থাকলে নোকিয়া, এইচএমটির মতো রাঘব বোয়ালেরাও সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায়। তাই গুড বলে বসে থাকলে গ্রেট হওয়া যায় না বরং আজকের সময় লাগাতার কাজ করে যেতে হয়। নইলে গায়েব হতেও সময় লাগে না।
শুরুতে ভালোই লাগছিলো। পুরো এলাকায় এই ব্যবসায় জড়িতদের সাথে পরিচয় হয়ে গেলো। আমাদের দশ জন এজেন্ট ছিলেন। আমি যোগ দেয়ার পর আরও পাঁচ জন বাড়িয়ে দেয়া হলো। সকাল আটটার মধ্যেই আমাদেরকে গোদামে চলে যেতে হতো। এজেন্টদেরকে টাকা দিয়ে বিদায় করলেই ওরা সাইকেল রিক্সা নিয়ে দুরদুরান্ত গ্রামে চলে যাবে স্ক্র্যাপ সংগ্রহ করতে। বিকেল তিনটে থেকে ওদের ফেরা শুরু হয়ে যাবে। ওরা দশ থেকে বারো টাকার মধ্যে পুরনো লোহার বস্তু কিনে আনবে। ঐ লোহা আমরা পনেরো ষোল টাকায় কিনে নেবো। লোহা ছাড়াও প্লাস্টিক, এলুমিনিয়াম, স্টিল তামা ইত্যাদি নির্মিত পুরনো সামগ্রীও আসে। দাম আর লাভের হিসেব সম্পুর্ন আলাদা। যখন আমাদের গোদাম ভরে যায় তখন লোক লাগিয়ে বাছাই করে কোয়ালিটি অনুযায়ী মাল ফেক্ট্রীতে পাঠিয়ে দিতে হয়। প্রথম প্রথম সপ্তাহে দুই ট্রাক পর্যন্ত মাল দেয়া শুরু হলো অতএব আয় ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম এই ব্যবসায় অনেক চতুরতা আছে।
বিকেলে যখন এজেন্টরা মাল নিয়ে এসে জমা দেয় তখন আমাদেরকে ওদের বস্তা খুলে দেখতে হয় যাতে কোন খারাপ আইটেম না এসে যায়। এর পর ওজন করে ওদের লাভের অংশ দিয়ে দিতে হয়। কয়েক মাস পর লক্ষ্য করলাম তিন চার জন এজেন্ট একদম নতুন লোহার রড নিয়ে আসে। ওরা তাড়াতাড়ি এসে যায়, মালও বেশি আনে আর সবচেয়ে বেশি আয় ওদেরই হয়। ওদের আনা লোহা পুরনো বা ব্যবহার করা থাকে না। একদম ঝকঝকে রড আর বিভিন্ন ধরনের লোহার স্ট্রাকচার। কোথা থেকে এমন মাল আসছ জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু সদুত্তর পেলাম না। উল্টো আমার দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে একজন বললো "আফনে ঐসব দিয়ে কি করবেন? লোওয়া যখন, উজন কইরা ফইসা দিলেই অইলো"। আমার প্রচন্ড রাগ উঠল। ওদের সঙ্গে বচসা না বাড়িয়ে সন্ধ্যের পর ভাই সাহেবকে ধরলাম। উনি বললেন ওরা চুরি করে না। বেশিরভাগ সরকারি অফিস থেকে কেনা লোহা। বিভিন্ন অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক আছে। টাকা দিলেই অফিসাররা পড়ে থাকা মাল দিয়ে দেয়। আমি তো শুনে থ হয়ে গেলাম। তার মানে এরা চুরির মাল নিয়ে আসে। নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলাম না। যতই ওরা টাকা দিয়ে কিনে আনুক এসব তো জনগণের সম্পদ। এই লোহা আমরা নিতে পারি না। পরোক্ষভাবে আমরা এই দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছি। ভাই সাহেবের সাথে শুরু হয়ে গেলো বচসা। অনেক বোঝালাম কিন্তু উনার সেই একই যুক্তি। আমরা না কিনলে অন্যরা কিনবে। আর আমরা তো ফ্রী আনছি না। টাকা দিয়েই কিনছি। উনি আমাকে বোঝালেন এসব এত বাছাবাছি করলে এই ব্যবসা চলে না। অতএব এতো ছোট বিষয় নিয়ে চিন্তা না করে কিভাবে ব্যবসা বাড়ানো যায় তা ভাবা দরকার। আমি মানতে পারলাম না। কথাটা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। সারা রাত চিন্তা করতে থাকলাম। আমি কি ঠিক করছি?
পরের দিন সকালে ভাই সাহেবকে বলে দিলাম যে এসব মাল কেনা ছেড়ে দিতে হবে। নইলে আমার দ্বারা এই ব্যবসায় পার্টনার থাকা সম্ভব হবে না। এর মধ্যে ছয় মাস হয়ে গিয়েছিল। সম্পর্ক খারাপ না করে পার্টনারশিপ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দিলাম। ভাই সাহেব অনেক বোঝালেন কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম সরকারি মাল কেনা বন্ধ করতে হবে নইলে আমি স্ক্র্যাপের ব্যবসা ছেড়ে দেবো। আমার জিদ দেখে শেষমেশ হিসেব নিকেষ করে আমার খাটানো টাকা ঘুরিয়ে দিলেন।
কয়েকদিন আমি আবার কর্মহীন হয়ে গেলাম। তখনও দিদির ঘরে থাকতাম। ভাই সাহেবের সঙ্গে যদিও আর ব্যবসা করি না তবুও সম্পর্ক ঠিকই আছে। কি করব ভাবতে ভাবতেই দিন কেটে যাচ্ছিল। প্রায় দুমাস পর আমার এক মামার ছেলে রফিক একদিন আমাকে ওর অফিসে ডেকে পাঠালো। বয়সে ও আমার থেকে মাত্র কয়েক মাস বড়ো তাই আমরা বন্ধুর মতো থাকতাম। ছেলে বেলায় মামার বাড়ি এলেই ওর সঙ্গে খুব খেলাধুলা করতাম। রফিক বরপেটায় একটি কম্পিউটার সেন্টার খুলেছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এমনকি বিএ পাস করা ছেলেরা ওর সেন্টারে কম্পিউটারের ডিপ্লোমা কোর্স শিখতে আসে। কোর্স অনুযায়ী মাসিক পাঁচশ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত ফীজ ধার্য করা আছে। দেখলাম ওর ব্যবসা ভালোই চলছে। আমাকে ও পরামর্শ দিল আমি যেন পাঠশালায় একটি ব্রাঞ্চ খুলে নেই। চার পাঁচ লাখ টাকা খরচ হবে কিন্তু পাঠশালায় এই ব্যবসা আরও ভালো চলবে। আলাদা করে আমাকে লাইসেন্স নিতে হবে না। ব্রাঞ্চ হিসেবে আমার সেন্টার চালাতে পারব।
বরপেটা জেলার ছোট্ট শহর পাঠশালা ইতিমধ্যে পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে এসেছে। অসংখ্য সরকারি বেসরকারি স্কুল কলেজ গজিয়ে উঠেছে পাঠশালায়। স্বাভাবিকভাবেই অনেক ছাত্র কম্পিউটার কোর্স করতে চাইবে। তাই কম্পিউটার সেন্টার খুললে আয় ভালো হবে। আত্মীয় স্বজন দু একজনের সঙ্গে আলোচনা করলাম। সবাই বললেন ভালোই হবে। আলোচনা মতো কাজ শুরু হয়ে গেল। একটি অফিস ভাড়া নিয়ে শুরু করলাম কম্পিউটার সেন্টার। আমার আগেই কম্পিউটারের ডিগ্রি নেয়া হয়ে গিয়েছিল তাই আলাদা ভাবে ট্রেইনার রাখার দরকার হলো না। ধীরে ধীরে ছাত্র ভর্তি শুরু হয়ে গেল। টাকা খুব একটা আসছিল না তাই স্পোকেন ইংলিশ কোর্সও চালু করে দিলাম। শিক্ষক আমিই। ছয়মাস চালানোর পর এই ব্যবসায়ও বিরক্তিকর হয়ে গেলো। ছাত্ররা সময়মতো ফীজ জমা দেয় না। নিয়মিত ক্লাসে আসে না। আর যেমন ভেবেছিলাম তেমন এডমিশানও হলো না। ধীরে ধীরে আমার আগ্রহও কম হতে লাগলো। অনেক চিন্তা করে দেখলাম বেশিদিন কম্পিউটার সেন্টার চালানো সম্ভব হবে না। লাভ তো হচ্ছেই না উল্টো ট্রেনিং দেয়া ক্লান্তিকর মনে হচ্ছিলো। ভাবলাম এই ব্যবসাও ছেড়ে দেবো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। খুঁজতে লাগলাম কেউ যদি পুরনো কম্পিউটার আর সেন্টারের আসবাবপত্র কিনে নেয়। পেয়েও গেলাম। আমার কম্পিউটার সেন্টারের পাশে একটি বেসরকারি স্কুল খুলেছিল। একদিন হেডমাস্টার সেন্টারে এলেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন উনি স্কুলের জন্য পুরনো কম্পিউটার খুঁজছেন। আমি বললাম আমার কম্পিউটারগুলো বিক্রি করব। উনি রাজি হয়ে গেলেন। মোট আটটি কম্পিউটার, প্রিন্টার আর ফার্নিচার উনার কাছে বিক্রি করে দিলাম। অনেক টাকা লোকসান হলো। যত টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম তার অর্ধেকও বেরিয়ে এলো না। আরেক ভুল সিদ্ধান্তে আমার মূলধন প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল।
আবার শুরু হলো চিন্তাধারা। ক্যাপিটেল তো অর্ধেক শেষ। সময় নস্ট হলো প্রায় দেড় বছর। এখন কি করা যায়। হাতে জমা টাকা দিয়ে কি ব্যবসা করা যেতে পারে ভেবে পাচ্ছিলাম না। অনেকের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। খবরাখবর নিলাম। কিন্তু এই টাকায় করতে পারা যুতসই কোন ব্যবসা নজরে এলো না। অগত্যা ঠিক করলাম, আরও কয়েক বছর চাকরি করব। বেসরকারি কোম্পানীতে সাত আট বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। আরেকবার চাকরি পেতে সময় লাগবে না। বিভিন্ন চাকরির ওয়েবসাইটে প্রোফাইল বানালাম। অনেক পুরনো বন্ধুদেরকে বায়োডাটা ইমেইল করে দিলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই জবাব আসা শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার এক বন্ধু মহারাষ্ট্রের পুনায় আইবিএমে চাকরি করে। আমাকে ফোন করে জানালো পুনায় চলে যেতে। ওদের কোম্পানিতে নাকি চাকরি সহজেই হয়ে যাবে। আমি ভাবলাম আর কি কি সুযোগ পাওয়া যায় দেখে নেই। এর পর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।
কয়েকদিন পর মুম্বাইয়ে কর্মরত আমাদের গ্রামের একটি ছেলে জানালো ওদের কোম্পানিতে কোম্পানির মালিকের জন্য একজন বিজনেস সেক্রেটারি চাই। আমি চাইলে বায়োডাটা পাঠাতে পারি। আমাকে ও মুম্বাই মিররে ছাপা এডভার্টাইজমেন্ট ইমেইল করে দিল। কোম্পানির মালিক আমাদের আসামের। কয়েকদিন পর মুম্বাই থেকে কল এলো। ডিরেক্টর আমার ইন্টার্ভিউ গুয়াহাটিতে নেবেন বলে আমাকে জানিয়ে দেয়া হলো। ইন্টারভিউয়ে অনেক আলোচনার পর আমাকে মনোনিত করা হলো। পুনার বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করলাম । তুলনামূলক ভাবে মুম্বাইর কোম্পানিতে বেতন বেশি আর থাকার জন্য কোম্পানী ফ্ল্যাটও দেবে। তাই মুম্বাই যাওয়াই ঠিক হবে। বাড়ি ঘর ছেড়ে আরেকবার অন্য রাজ্যে যাওয়া ভালো লাগছিল না। কিন্তু আপাতত কোনো অপশন নেই। ব্যবসা করতে হলে আরও টাকার প্রয়োজন। পরের সপ্তাহে মুম্বাইর ফ্লাইট নিয়ে চলে গেলাম নতুন কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে।
প্রায় দু'বছর হয়ে গেছে এখানে। শুরুতে ভালোই লাগছিলো। এখন আবার বিরক্তি এসে গেছে। এখানে ফিউচার খুব একটা আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি প্রফেশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে এসেছি তাই এই কোম্পানির ঘরোয়া পরিবেশে কাজ করা সয় না। সময়ানুবর্তিতা নেই, নেই কোন নতুনত্ব। তাই কয়েকদিন থেকেই ভাবছি হয়তো আবার অন্য কোথাও যেতে হবে। আসল উদ্দেশ্য কিন্তু আমার একটি। চাকরি নয় , ব্যবসা। তাই টাকা জমাতে হবে। অনেক টাকা না হলে বড় ব্যবসা করা যাবে না। এমনিতেই ভারতের কর ব্যবস্তা এত ভয়াবহ যে রোজগারের অর্ধেক তো সরকারই নিয়ে যায় বিভিন্ন ছুতোয়। প্রতিটি লেনদেনে নিজের পকেট থেকে সরকার বাহাদুরকে আলগোছে একটি অংশ দিয়ে দিতে হয়। তাই বড় ব্যবসা না করলে হবে না। আর বড় ব্যবসার জন্য চাই বড় মূলধন। যার জন্যই আরও কয়েক বছর চাকরি করতে হবে।
মুম্বাইয়ে অন্যান্য কোম্পানিতে চাকরির খোঁজ করলাম। আশানুরূপ কোন ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। কয়েক যায়গায় জয়েন করতে পারতাম কিন্তু কাজ পছন্দ হচ্ছিল না। অবশেষে ঠিক করলাম দেশের বাইরে চেষ্টা করতে হবে। ফায়দা দুটো। আয়কর বাঁচানো যাবে আর প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যাবে। প্রতিযোগিতা মানেই নতুনত্ব আর পদোন্নতির সুযোগ। প্ল্যান করলাম আগে চাকরি ছেড়ে দেই। তারপর মাস দুয়েক বাড়িতে থাকব। এর পর ভালো সুযোগ পেলেই বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করব।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাড়ি চলে এলাম। বাড়িতে বসে বসে বিভিন্ন দেশে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা আরম্ভ করলাম। যখন গুজরাটে কাজ করতাম তখন আমার সাথে বিহারের এক ছেলে বিবেক শুক্লা ছিল। খবর পেলাম বিবেক আজকাল দুবাইয়ে থাকে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ হলো। ওই বললো শর্ট টাইম চাকরীর জন্য দুবাই ভালো বিকল্প। দেশের থেকে বেশি দুর নয়। মাত্র চার পাঁচ ঘন্টায় গুয়াহাটি থেকে দুবাই পৌঁছা যায়। বিবেককে আমার বায়োডাটা পাঠালাম যাতে ও আমাকে পরামর্শ দিতে পারে। আমার পড়াশোনা আর কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু আছে জানতে পারলেই সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে। বিবেক জানালো চাকরি পাওয়া কঠিন হবে না। হয়তো প্রারম্ভে ভালো বেতন পাওয়া নাও যেতে পারে কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা দেখে যে কোন এম্প্লয়ার সহজেই চাকরি দিয়ে দেবে।
মাত্র ৪০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত দুবাই বিশ্বের শীর্ষ দশ শহরের মধ্যে স্থান পেয়েছে। উন্নত স্থিতিশীল অর্থনীতি, অত্যাধুনিক পরিকাঠামো, আইন কানুন আর জীবনধারণের উৎকৃষ্ট মানদন্ড ইত্যাদি সারা দুনিয়াকে আকৃষ্ট করেছে এই শহরের প্রতি। মাত্র তিন মিলিয়ন লোক এই শহরে বাস করেন যার ৮০% প্রবাসী। এমন কোন দেশ নেই যেখানকার নাগরিক দুবাইয়ে পাওয়া যাবে না। ভ্রমণ স্থান আর শপিং এর জন্য দুবাই বিশ্বের পছন্দের তালিকায় সর্ব প্রথম বললে ভুল হবে না। মুলত ইসলামী রাজতন্ত্রের এই ছোট্ট শহরটিতে বিশ্বের সর্বোচ্চ অট্টালিকা বুর্জ খলিফা বানানো হয়েছে যা ভ্রমণকারীদের আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু। উন্নত অর্থনীতির আরেকটি কারক মাটির নিচে থাকা জ্বালানি তেল। ১৯৬৬ সাল থেকে এই তেল খনন কার্য আরম্ভ হয়েছে আর আজও চলছে।
ভাবলাম ভালোই হবে। নিশ্চয়ই দুবাইয়ে চাকরি পেয়ে যাবো। শুনেছি ভালো চাকরি পেলে দেশের থেকে কয়েকগুণ বেশি বেতন পাওয়া যাবে। আর ট্যাক্সও দিতে হবে না। কয়েক বছর চাকরি করে মোটামুটি ভালো অঙ্কের টাকা জমানো হয়ে গেলেই দেশে ফিরে আসব। নতুন উদ্যমে শুরু করব ব্যবসা। সারা জীবন চাকরি করতে পারব না। দুবাইয়ে চাকরি পেতে হলে তিন মাসের ভিজিটর ভিজা নিয়ে একজন ভ্রমণকারী হিসেবে যেতে হবে। ওখানে থেকে চাকরি খুঁজতে হবে। বিবেক আমার জন্য ভিজা বানিয়ে দিল।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরের ১ তারিখ গুয়াহাটি থেকে ইন্ডিগোর বিমানে বসলাম। গন্তব্য দুবাই, ভায়া দিল্লি। ঘরবাড়ি ছেড়ে আবার চাকরির উদ্দেশ্য চললাম। প্লেনে বসেই চোখ মুদলাম। খারাপ লাগছিল। বন্ধু বান্ধব পরিবার পরিজন ছেড়ে আরেকবার চলে যেতে হচ্ছে। অজানার উদ্দেশ্যে। কখন ফিরবো কি ঠিক। জীবন ঘড়ির কাঁটার মতোই। লাগাতার ঘুরতে থাকবে। আজ এখানে তো কাল ওখানে। এর মধ্যে কখন ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে যাবে কেউ জানে না। আর যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ থাকবে আশা, স্বপ্ন আর পরিকল্পনা। ফুটফুটে ছেলে দুটোর কথা মনে পড়ছিল। চোখের কোন ভিজে এলো। যখন প্লেন আকাশে উড়ছে, তখন আমার চোখে কি ঘুম। বাস্তব আর স্বপ্ন সব মিলে মিশে একাকার।
+-+-+-+-+-+-+-++-+-+-+-+-+-+-++-+-+-+-+-+-+-+
শরীফ আহমদ
তারিখ : ২০ জুন, ২০১৮
ইমেইল: infinite.shareef@gmail.com
তারিখ : ২০ জুন, ২০১৮
ইমেইল: infinite.shareef@gmail.com
(পুনশ্চ: এই লেখা রোটারি ক্লাব অব বর্ডারলেন্ড করিমগঞ্জের বার্ষিক মুখপত্র "সংকল্প" তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত)
Comments
Post a Comment