"তিতির"


উহ কি ঠাণ্ডা! এবার শীত আগেই এসে গেছে। শরৎ কালে এমন শীত ভাবা যায় না! তিতির এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? রাঘব কি পানের সঙ্গে কোনো নেশার জিনিস মিলিয়ে দিয়েছিল? না তিতির গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল? মনে পড়ছেনা। আজ খুব ধকল গেছে। সম্ভবত তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। রাঘব গাড়িতেই একটু আধটু আদর করতে চাইছিল। কিন্তু খারাপ রাস্তা আর সামনে থেকে হেডলাইট জ্বালিয়ে ধেয়ে আসা ট্রাক বাধ সাধল। এরপর আর কিচ্ছু মনে নেই। তিতির এসব ভাবতে ভাবতে গেঁয়ো পথ দিয়ে এগিয়ে চলছে।
নবমীর রাত। চাঁদের আলোয় নেয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। তিতির ওর বন্ধু রাঘবের সাথে পূজো দেখতে গিয়েছিল করিমগঞ্জে। তিতিরের মা রাঘবের সাথে মেয়েকে বাইরে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু মেয়ের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত মানলেন। যাওয়ায় আগে বারবার বলে দিলেন যেন রাত নটার আগেই ফিরে আসে তিতির। সুপ্রাকান্দি থেকে করিমগঞ্জ মাত্র দশ কিলোমিটার।
এই রাঘব একটা গাধা। প্রমিস করেছিল দশটার আগেই গাড়িতে করে এনে নামিয়ে দিয়ে যাবে। কিন্তু এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করে আর পূজোর মণ্ডপ দেখতে দেখতে দেরি হয়ে গেল। আহার রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার আর শেষমেষ সুযোগ পেয়েই তিতিরের ঠোঁটে এক সাঙ্ঘাতিক কামড়। জোর করে‌ হলেও একটা চুমু। ভাগ্যিস রক্ত বেরোয়নি। শিববাড়ির মোড়ের পান দোকানের পেছনে হঠাৎ করে শুনশান রাস্তা আর এই সুযোগটাই খুঁজছিল রাঘব। এমন সুযোগ সহজে পাওয়া যায়না। হাজার টাকা খরচা করে রাঘব পূজো দেখালো। প্রেম-টেম নাই থাকুক। বন্ধু হিসেবে এটুকু কিচ্ছু না। রাঘবের লম্বা হাত সাপের মত হিস হিস করে তিতিরের মাথার পেছন থেকে শুরু করে পিঠ বেয়ে ক্রমে শরীরের নিচের দিকে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু পেছন থেকে আসা বাইকের আলোয় সম্বিত ফিরে পেলো দুজনে। এক হয়ে যাওয়া দুটো শরীর আলাদা করে আবার পথ চলতে লাগল ওরা। এর পর এখানে ওখানে ঘুরে তিতিরকে সুপ্রাকান্দিতে এনে ছেড়ে দেবে বলে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসলো রাঘব। গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে কোকাকোলার বোতল বের করে একটু খেলো। তিতিরের দিকে এগিয়ে দিল বোতল। তিতির খেলো না। ও জানতো কোকাকোলার সঙ্গে নিশ্চয়ই হুইস্কি মেলানো আছে। রেলগেট পার হয়েই রাস্তা শুনশান। তীব্র বেগে গাড়ি ছুটে চললো সুপ্রাকান্দির দিকে। পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে ভেবে তিতির স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল।
এখন রাত সম্ভবত সাড়ে বারোটা। হাইওয়ে থেকে তিতিরের বাড়ি এক কিলোমিটারের বেশি হবে না। বাজার থেকে দশমিনিটের রাস্তা পেরোলেই তিতিরদের বাড়ি। দুর থেকে ভেসে আসছে ঢাকের শব্দ। তিতিরদের গ্রামে কোনো পূজো নেই। বাজারে দুটো মন্ডপ। একটি সার্বজনীন আর একটি ইয়ং বয়েজ ক্লাবের পূজো। তিতির ভাবছিল আসার সময় বাজারের প্রতিমাও দেখে আসবে। কিন্তু অনেক রাত হয়ে গেছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। এতো রাতে ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌঁছে গেলেই রক্ষে। হাইস্কুল বিল্ডিং পেরিয়ে দেখতে পেলো সামনে থেকে দুজন লোক আসছে। চাঁদের জোছনায় ওদের শরীরের অস্বাভাবিক দীর্ঘ ছায়া অনেক দুর থেকে দেখা যাচ্ছে। এখনও অনেক দুর কিন্তু ওদের কথা স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে। তিতিরের একটু ভয় হলো। এত রাতে দুজন লোক যদি ওকে আক্রমণ করে বসে? ভাবতে ভাবতেই ওরা তিতিরকে ক্রস করে চলে গেল। কি অদ্ভুত, একবার ফিরেও তাকালো না। যেখানে দিনের বেলা ছেলে বুড়ো সবাই তিতিরের সুডৌল বুকের দিকে তাকিয়ে থেকে, পেছনে ফেরে কোমরের নিচে নজর দিতে একটুও লজ্জা করে না, এত রাতে লাল শাড়ি আর হাতকাটা ব্লাউজ পরা একা মেয়ে ওদের কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে গেল! কেমন যেন আশ্চর্য লাগলো তিতিরের।
রবীন্দ্র সদন গার্লস কলেজে থার্ড সেমিস্টারের ছাত্রী তিতির। ফিলোসফি অনার্স। রাঘবের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রথম দিন থেকেই। একবার কলেজের এক অনুষ্ঠানের পর ও তিতিরকে প্রোপোজ করে বসে। তিতির জবাব দেয়নি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। বন্ধুত্ব থাকুক। ফ্রেন্ডস উইদ বেনিফিটস সবচেয়ে ভালো। আনন্দ করা যাবে আর মিছেমিছি নাটক করতে হবে না। আধুনিক যুগের মানুষ তিতির। শরীর মানে রক্ত মাংসের চাহিদা থাকবে। এতো মরালিটি নিয়ে লাভ নেই। চাহিদা আর যোগানের ব্যালেন্স‌ই বড়ো কথা। রাঘব কলেজের অনুষ্ঠান বা পূজো পার্বনের সুযোগ ছাড়ে না। বাবা দাপুটে রাজনীতিবিদ। ছেলেকে গাড়ি কিনে দিয়েছেন। তিতির প্রায়ই রাঘবের গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। তবে একটু আধটু চুমু, এখানে ওখানে ছোঁয়াছুঁয়ির বেশি অবশ্য কিছুই হয়নি। রাঘব আরও চায়। তিতির অপেক্ষা করতে বলে। তবে রাঘব হাত দিলেই তিতিরের শরীরে বিদ্যুৎ ছুঁয়ে যায়। অদ্ভুত এই শরীরী টান। একদিন যে সব বাঁধ ভেঙে যাবে তিতির তা জানে। আজ‌ও দ্বিতীয়বার সীমা অতিক্রম করা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
ব্রিক কোম্পানি পেরিয়ে ছুটে চলছে মারুতি স্যুইফট। রাঘবের এক হাত স্টিয়ারিংয়ে আর আরেক হাত তিতিরের গাল ছুঁয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু সববারের মতো এবারও বাঁধা। তীব্র জোরে হর্ণ বাজিয়ে আপার লাইট জ্বালিয়ে ধেয়ে আসছে একখানা ট্রাক। রাঘব আর তিতির হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে ট্রাক একেবারে রাঘবের গাড়ির সামনে। এরপর তিতিরের আর কিচ্ছু মনে নেই।
আজ এত জোৎস্না চারদিকে। চাঁদ কি ঠিক মাথার উপরে? ছায়াও পড়ছে না। রেললাইন পেরিয়ে গেলে ছোট্ট একটি খাল। কালভার্ট শেষ হতেই তিতির দেখে সামনে থেকে একটি মস্ত বড় কালো কুকুর আসছে। তিতিরের চোখের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে পালালো। আর দুটো বাড়ি পেরিয়ে গেলেই বাঁচা যায়। মা নিশ্চয়ই চিন্তা করছেন। এত দেরি করা ঠিক হয়নি। ফাইনালি তিতির পৌঁছে গেছে। কিন্তু একি? ঘরের সামনে এত ভীড় কেন?
তিতিরের বুক কেঁপে উঠল। নিশ্চয়ই কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। আশপাশের সবাই জড়ো হয়েছে। মাকে সামলানো যাচ্ছে না। চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছেন। "এ কি হলো আমার মেয়ের! কেন এভাবে শুয়ে আছে! বলছিলাম করিমগঞ্জে যেতে হবে না। ঐ রাঘব‌ই মেরে ফেললো আমার ফুলের মতো মেয়েকে। নিশ্চয়ই মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে"। শুনে তিতির চমকে উঠলো। তিতিরকে মেরে ফেলছে মানে? ও কি মরে গেছে তবে? তিতির তো দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। "মা, মা, এই যে আমি" বলে তিতির দৌড়ে গেল ভেতরে। কিন্তু ওকে কেউ দেখছেই না। যেন সবার চোখের সামনে ও অদৃশ্য। বিশ ত্রিশ জন পুরুষ মহিলা ঘিরে আছেন তিতিরের মা কে। ঘরের মাঝখানে একখানা পাটিতে এক মৃতদেহ। সাদা চাদরে ঢাকা। একজন এসে লাশের উপরের ভাগ থেকে কাপড় সরিয়ে দিলেন। তিতির চেয়ে দেখে এতো ওর‌ই লাশ! ভয়! এক অদ্ভুত ভয়! বিশ্বাস হচ্ছে না। তিতির পেছনের দরজা দিয়ে দৌড়ে পালালো। সব বোঝে গেছে তিতির। এখন সব স্পষ্ট হয়ে গেছে। মনে পড়ে যাচ্ছে রাঘবের রক্তাক্ত মুখে চীৎকার, "তিতির, তিতির, আই এম স্যরি"। রাঘব ব্রেক কষে ছিল কিন্তু যা হ‌ওয়ার ততক্ষণে হয়ে গেছে। তিতিরের কাছে এখন সব পরিষ্কার। ও আর বেঁচে নেই।
(নোট: জীবনে প্রথম একটি ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করলাম। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। কেউ বাচ্চামো মন্তব্য করলে আনফ্রেন্ড করবো।)
শরীফ আহমদ | ২৭ অক্টোবর, ২০১৮ ইং

Comments

Popular posts from this blog

দেশ বিদেশের গল্প

বাইশটি ভাষার পণ্ডিত ড° মহম্মদ শ্বহীদুল্লাহের বিষয়ে...

প্রবাসের ডাক