এন‌আরসি: ষড়যন্ত্রের সাত কাহন


এন‌আরসি যে এক পরিকল্পিত রাষ্ট্রিয় ষড়যন্ত্র তা বোঝা আর কঠিন র‌ইল না। উগ্র জাতীয়তাবাদী অসমিয়ারা আগে থেকেই দাবি করে আসছে আসামে পঞ্চাশ লাখ এমন কি এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশী আছেন। অসমিয়াদের কাছে বাংলাদেশী মানে মিঞা, বাংলাদেশী মানে দাঁড়ি টুপি থাকা মুসলমান এমনকি বাংলাদেশী মানে হিন্দু বাঙ্গালী হলেও আপত্তি নেই। 'আসাম অসমিয়াদের' এটাই যাদের স্লোগান তারা তো প্রত‍্যক্ষভাবে সার্বভৌম সংবিধানের বিরোধীতা করছে। এর পর‌ও বাঙ্গালীদের মধ্যে বেশিরভাগ, বিশেষ করে মুসলমানদের ভরসা ছিল এই এন‌আরসির উপর। যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে চলছে তবে এই প্রক্রিয়া হোক। কিন্তু শুরু থেকেই একে একে যা চলছে তা দেখে প্রক্রিয়াগত নিরপেক্ষতার উপর প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। সুপ্রিম কোর্ট সমালোচনার উর্ধ্বে কি না জানি না কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?

১) ডি ভোটার আর তাদের পরিবারের সদস্যদের নাম উঠবে না এটা সবচেয়ে বড় চক্রান্ত। হাই কোর্টের এক মামলার রায়ের উপর ভিত্তি করে হাজেলা সাহেব এমন সময় এই ফরমান জারি করেন যখন সুপ্রিম কোর্টে গরমের বন্ধ চলছে। স্মার্ট মুভ! ইমারজেন্সি হিয়ারিং থাকলেও সুপ্রিম কোর্ট এনিয়ে নাকি পরবর্তীতে শুনানি দেবে। প্রশ্ন হলো ডি ভোটার বলতে ঐসব ব‍্যক্তি আর তাদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছে যাদের মামলার রায় হয়নি, যারা ইতিমধ্যে ভারতীয় বলে প্রমাণিত হয়ে গেছেন কিন্তু ডাটাবেজ আপডেট হয়নি,‌ এবং যাদের নামে ভুলবশত নোটিশ এসেছে বা নোটিশ আসেইনি আর একতরফা ভাবে বিদেশি ঘোষিত হয়েছেন। আর পরিবারের সদস্য বলতে যাদের জন্ম এদেশে হয়েছে তাদের নাম‌ও‌ কাটা পড়েছে। সিটিজেনশিপ বাই বার্থ তবের গরুর রচনা হিসেবে ছিঁড়ে ফেলতে হবে? একমাত্র প্রমাণিত বিদেশি ছাড়া বাকিদের কি দোষ? ইচ্ছে করেই যাতে বড় অঙ্কের লোককে তালিকার বাইরে রাখা যায় এটা যে তেমন‌ই একটি ফন্দি নয় কেন মানব?

২) উজান আসাম আর নিম্ন আসামে ভেরিফিকেশনের সময় সমান কড়াকড়ি হয়নি। বাঙ্গালী প্রধান জেলাগুলোয় যেভাবে কঠোরতা দেখানো হয়েছে অসমিয়া প্রধান জেলাসমূহে এমন কড়াকড়ি করলে ৩০% বা তার‌ও বেশি অসমিয়া নাগরিকদের নাম উঠত না খসড়ায়, এমন ধারণা অনেকেরই। বাঙ্গালী বিদ্বেষী অসমিয়াদের মতো সুপ্রিম কোর্ট‌ও‌ কি অনুমান করে বসে আছে আসামে বাঙ্গালী মানেই অবৈধ বিদেশী? আইন কি অনুমান নির্ভর? সবার কাছে আইন যে সমান নয় এর প্রমাণে আর কি চাই?

৩) ম‍্যাজিক ফিগারটা কি তাহলে? বিশ লাখ? চল্লিশ লাখ? নাকি এক কোটি? আর যারা একবার মিস্টি খাচ্ছেন আর আরেকবার বলছেন অনেক বিদেশীর নাম উঠেছে সম্পুর্ন খসড়ায় তারা কিসের ভিত্তিতে এসব সংখ্যার অনুমান করছেন? না যখন বিএস‌এফ সীমান্তে বসে সাপ লুডু খেলছিল তখন জয় আই অখমের সন্তানরা বসে বসে গুনছিলেন কতজন বাংলাদেশী ভারতে ঢুকছে? এই প্রশ্নটা করবে কে? আর কিভাবে এত বিদেশি ভারতে প্রবেশ করল এটা কি একটি স্টুপিড কোয়েশ্চেন?

৪) বন‍্যার জন্য শেষ মুহূর্তে যখন চুড়ান্ত তালিকা প্রকাশের তারিখ আদালত আরও কয়েকদিন পিছিয়ে দিল তখন একদিন স্থানীয় কয়েকটি দৈনিক (বিশেষ করে বরাকের) স্ক্রিনশট সহ এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের পর্দা ফাঁস করে। একাংশ এন‌আরসি সেবাকেন্দ্রে গুয়াহাটি থেকে সাদা কাগজে কোনো নাম দস্তখত বা কর্তৃপক্ষের মোহর ছাড়াই এক রহস্যময় লিস্ট এসে পৌঁছেছে। এতে অনেকের নাম আছে যাদেরকে চুড়ান্ত খসড়া থেকে বাদ দিতে হবে। নামের পাশে ডি ভোটার লেখা আছে, কিন্তু আদতে এরা ডি ভোটার নয়। এই খবরটি দেখেই কর্তৃপক্ষের উপর বিশ্বাস আর বাকি থাকল না। এ নিয়ে হাজেলা বাবু কোন স্পষ্টিকরণ দেননি। এই লিস্ট কে পাঠালো, কেন পাঠালো কেউ জানে না। কিন্তু উদ্দেশ্য ঠিকই বোঝা গেল। ফলাফল ৪০ লাখ তালিকাছুট। সুপ্রিম কোর্ট কি এত‌ই ন‍্যাকা না আমাদের প্রতিবাদের সত্ত্বা মরে গেছে? আমি আমার ব‍্যক্তিগত ফেইসবুক আইডি থেকে এই হোয়াইট লিস্টের ব‍্যাপারে জানতে গেলে এন‌আরসির অফিশিয়াল ফেইসবুক পেইজ আমাকে ব্লক করে দেয়।

৫) কেন্দ্র সরকার, রাজ‍্য সরকার আর এন‌আরসি কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করেছেন এক বার্তা নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দিতে আর তা হলো‌ সম্পুর্ন খসড়ায় একজন‌ও ভারতীয়র নাম ছাড়া পড়বে না। ৩০ জুলাইয়ের পর এটাই সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার বলে প্রমাণিত হলো। নাম কাটা গেছে ছোট ছোট শিশুদের যাদের পিতা-মাতার নাম উঠেছে।‌ এক‌ই পরিবার কয়েকজনের নাম উঠেছে বাকিরা ছাড়া পড়েছে। নাম ছাড়া গেছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর, আসাম বিধান সভার প্রথম অধ‍্যক্ষের পরিবারের সদস্য সহ অসংখ্য সেনাকর্মি এবং সরকারি চাকুরিজীবীদের যারা ১৯৭১ এর আগের নথি জমা দিয়েছেন। ফলস্বরূপ ৪০ লাখ তালিকাছুটদের মধ্যে কতজন ভারতীয় আর কতজন বিদেশি কেউ জানে না। কি আশ্চর্য! হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের ফসল এন‌আরসির মূল উদ্দেশ্য তবে কি মাঠে মারা গেলো না? সুপ্রিম কোর্ট প্রতীক হাজেলাকে এরজন্য হালকা ভৎসনা করতেও শুনা গেল না। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার জন্য‌ হাজেলাকে প্রসিকিউট কেন করা হলো না? যে এন‌আরসি কর্মিদের ভুলের জন্য এই ৪০ লাখ লোক আজ রাষ্ট্রহীন হয়ে মানসিক যাতনার শিকার তাদের বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নিল আদালত? পুরো প্রসেসটা কি তবে ছেলেখেলা নয়?

৬) এন‌আরসি নিয়ে কেউ আজেবাজে মন্তব্য করবেন না। পুলিশ আর সেনাবাহিনী পৌঁছে গেছে সব জায়গায়। ১৪৪ ধারা বলবৎ হয়ে গেছে। আপনার ফেইসবুক হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ম‍্যাসেজে নজর রাখছে সাইবার সেল। পোস্টার, ব‍্যানার, প্রেস‌ রিলিজ আর অনলাইনে বিজ্ঞাপনে চারিদিক ছয়লাপ। আসামবাসি শান্তির খাতিরে হোক বা পুলিশের লাঠিচার্জের ভয়ে হোক টু শব্দটি করলেন না। কিন্তু বিজেপির বিধায়ক শিলাদিত্য, যে নিজে জাল কাগজ দিয়ে (টিভিতে এনিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে) এন‌আরসিতে নাম উঠিয়েছে অদ‍্যোপান্ত শ্রাদ্ধ করে গেল সব নির্দেশনার। কখন‌ও‌ বলছে এন‌আরসি কর্মিরাই বাংলাদেশী, কখনও বলছে সব মুসলমান‌ই বাংলাদেশী আর‌ও কত কি! কিন্তু রাজ‍্য সরকার একটি ধমক‌ও দিল না। এদিকে মমতা ব্যানার্জি কিছু বললেই সাহেবদের গোঁসা হয়। রাজ‍্যের মানুষ যে এই শিলাদিত্যের কথায় কান দিয়ে কিছু একটা করে বসেনি তার জন‍্য মূখ‍্যমন্ত্রীকে ক্রেডিট দিয়ে লাভ নেই। উনি তো চুপচাপ বসে সতীর্থের কর্মকান্ড উপভোগ করছিলেন। না উনিও চাইতেন কিছু একটা হোক? বিজেপির বিধায়ক বলে শিলাদিত্য কি সব আইন কানুনের ঊর্ধ্বে? না এই ষড়যন্ত্র বিজেপির বিভাজক রাজনীতির আরেকটি অস্ত্র?

৭) ৪০ লাখ লোকের নাম বাদ গেছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এপিডব্লিউর দাবি অনুযায়ী চায় যে সমস্ত জেলায় বেশি নাগরিকের নাম উঠেছে তার ১০% আবার পরীক্ষা হোক। এপিডব্লিউ চায় এককোটি বিদেশি হোক, আসাম অসমিয়ার হোক, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ ভাবে কেন ভাবছে না? পুনর্নিরিক্ষন হোক এতে অসুবিধা নেই তবে যে চল্লিশ লাখ ছাড়া পড়ল তাদের ক্ষেত্রে কেন নয়? এর মধ্যে কয়েকজন তো আত্মহত্যা করেছেন। বাকিদের সাথে কি হবে কেউ জানে না। ঘোষিত বিদেশিদের সাথে কি করা হবে এটা না ভেবেই শুরু হয়ে গেছে বিদেশি খেদাওর তোড়জোড়? আরেকটি বঙ্গাল খেদাও না আরেকটা নেলী আসামবাসির কপালে আছে কেউ জানে না।

এছাড়াও অনেক কারণ আছে। বাঙ্গালী যত্রতত্র মার খাচ্ছে আজ। প্রতিবেশী রাজ‍্য থেকেও এন‌আরসির নামে নির্যাতন হচ্ছে, তাড়ানো হচ্ছে শ্রমিকদের। রাস্তায় বেরোলেই পাহাড়িদেরকে এন‌আরসির কাগজ দেখাতে হচ্ছে। কিন্তু আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ মনের আনন্দে আছেন। রাজ‍্যের ভেতর এখন শান্ত। ঝড়ের পূর্বের শান্তি না মেরুদন্ডহীন প্রতিবাদহীনতার শান্তি তা বোঝা যাচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্ট "তারিখ পে তারিখ" এর খেলা খেলবে আর আমরা না হয় হিন্দু মুসলমান খেলবো।

Note: Picture Taken from The Wire.

Comments

Popular posts from this blog

দেশ বিদেশের গল্প

বাঙলা অসমীয়া

সাবরমতি টু মথুরা