সারপ্রাইজ
ছুটির দিন আছরের নামাজের পর রাস্তায় রাস্তায় পায়ে হেঁটে চলা বরাবরই পছন্দের। মুম্বাইয়ের বাঙ্গালীপুরায় যারা থাকেন তারা জানেন রবিবার ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন রাস্তায় পা রাখা যায় না। রোজ এত ভীড় মুম্বাইর আর কোথাও হয় বলে মনে হয়না। মর্নিং ওয়াক করতে হলে অনেক দুর পার্কে যেতে হয় যা আমার পোষায় না। অগত্যা রবিবার বিকেলে কয়েক কিলোমিটার হাঁটা অভ্যাস হয়ে গেছে।
সোমবার থেকে শনিবার মোহাম্মদ আলী রোডের সব জায়গায় অসম্ভব ভীড়। এখানকার পাইকারি ব্যবসায়িদের থেকে মাল কিনতে দুর দুরান্ত থেকে খুচরো ব্যবসায়ীরা আসে। সাত সকালেই চীৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। সেই রাত দশ এগারোটা অবধি বিরাম নেই। শুধু রবিবার এই শহরের ব্যস্ততম অঞ্চলটি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কোন ভীড় নেই। কয়েকটি চায়ের দোকান, রেস্তোরাঁ আর দু চারটে মনিহারি দোকান ছাড়া বাকি সব বন্ধ। পরিস্কার রাস্তা। হই হুল্লোড় কিছুই নেই। মনে হয় আমার মতো শহরটিও এই দিন আরাম করে। অলস হয়ে যায়। ইচ্ছে মতো ঘুমোয়, ইচ্ছে মতো জাগে।
আছরের নামাজ শেষ করে চটি পরেই বেরিয়ে পড়লাম। অন্তত এক দেড় ঘন্টা পায়ে চলবো আজ। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দেখলাম সন্মুখের নাম না জানা গাছটিতে এক জুড়ো শালিক পাখির কি ঝগড়া। দুটো কুকুর পাক মেরে শুয়ে আছে আর বিরক্ত হয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে আছে যেন পাখি দুটোকে পেলে গিলে ফেলবে। বেটাদের ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে! শালিক দম্পতির সমস্যা কি কে জানে! আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া গলিতে সাকুল্যে তিনটে গাছ। দুটো নীম, আরেকটা কি জানি না। কয়েক পরিবার পাখি আছে ঐ গাছগুলোয়। সপ্তাহের অন্যান্য দিন পথচারীদের চেঁচামেচিতে এদের শব্দ শোনা যায় না। আজ ওদের দিন। যেন ওদের কলরব শুনতেই হবে সবাইকে।
ছোট্ট গলিটি অভার ব্রীজের নিচে গিয়ে মোহাম্মদ আলী রোডের সঙ্গে মিশে গেছে। এর দশ পনেরো বিল্ডিং এর আগে একটি বিহারী চায়ের দোকান। এদের তাজা দুধের চা বিখ্যাত। সপ্তাহের অন্যান্য দিন চায়ের জন্য লাইন লেগে যায় কিন্তু আজ দোকানের মালিক বসে বসে ঝিমোচ্ছে। একজনও খদ্দের নেই। দাড়িয়ে দাড়িয়েই চা দিতে বললাম। চা খেয়ে পয়সা দিতে গিয়ে দেখলাম সার্টের পকেটে একটি একশো টাকার নোট। খুচরো নেই। ইতস্তত করতে দেখে দোকানদার ভাঙ্গা গলায় বলল "বাদ মে দিজিয়ে বাবু"। অগত্যা এগিয়ে গেলাম। সিগারেট কিনলে খুচরো পেয়ে যাবো। যাওয়ার সময় চায়ের টাকা দেয়া যাবে।
রাস্তায় পা দিতেই দেখলাম দশ এগারো বছরের একটি ছেলে আমার দিকে চেয়ে আছে। ভিখিরি হবে। মুম্বাইয়ে এদের উৎপাত খুব বেশি। আমিও এদের দেখলে খুব বিরক্ত হই। টাকা দিতে হবে এজন্য নয়। এরা আগে থেকেই এমন ভাব করে যেন টাকা পাবে না। তাই আরামসে অপেক্ষা করবে আর যখনই আপনি পকেট থেকে টাকা বের করবেন তখনই শুরু হবে কান্না। কুচ খিলাদো, মাম্মি বিমার হ্যায়, আরও কত কি। সবচেয়ে বিরক্তিকর এরা আপনার পিছু ছাড়বে না। আপনি যদি দাঁড়িয়ে কারুর সাথে কথা বলছেন বা ফোনে কথা বলছেন তখন "একঠো রুপিয়া দিজিয়ে না বাবু" বলতেই থাকবে। উদ্দেশ্য আপনাকে এত বিরক্ত করা যাতে আপনি কিছু একটা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারেন।
আমার কাছে তো খুচরো টাকাই নেই। চোখ ফিরিয়ে চলতে লাগলাম। তিনটে বিল্ডিং এর পর একটি পান সিগারেটের দোকান। "এক মার্লবোরো লাইটস্ দো ভাইয়া" বলে একশো টাকার নোটটি এগিয়ে দিলাম। দোকানদার আমাকে চেনে। সিগারেট আর লাইটার এগিয়ে দিল। সাথে আমার অভ্যাস অনুযায়ী এক টুকরো শুকনো সুপারি দিতেও ভুলল না। সিগারেট জ্বালিয়ে সুপোরির টুকরো মুখে দিতেই দেখি ভিখিরি ছেলেটা আমাকে ফলো করে এখান পর্যন্ত এসেছে আর একটু দুর থেকে আমার দিকে চেয়ে আছে। বুঝলাম টাকা না দিলে ও আজ আমার পিছু ছাড়বে না। পান দোকানদার খুচরো টাকা ঘুরিয়ে দিলেন। ছেলেটিকে ডাকলাম। পকেটে হাত দিতেই গতকালকের একটি ভিডিওর কথা মনে পড়ে গেল।
কোনো একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি ভিডিও এসেছিল কাল। এক মদ্যপ বাবা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দশ বারো বছরের একটি ছেলেকে খুব পেটাচ্ছে। সাঙ্ঘাতিক ভায়োলেন্ট ভিডিও। ছেলেটি জোরে জোরে কাঁদছে আর ঐ লোকটা হাত পা দিয়ে বারবার মেরে যাচ্ছে। ভিডিওটি দেখে খুব রাগ উঠছিল। ভাবতে পারছিলাম না এই ভিডিওটি যে রেকর্ডিং করছে সে মানুষ না অমানুষ! রেকর্ড করা বাদ দিয়ে ছেলেটিকে মার খাওয়া থেকে বাঁচানো উচিত ছিল। যে পরিবারে বাবা নেশাখোর হয় সেই পরিবারে ছোট ছেলে মেয়েরা ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হয়। নেশাগ্রস্ত মানুষ কখনও পশু হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে এদের ছেলেমেয়েরা ভিক্ষা করতেও শুরু করে দেয়।
আজকের এই ছেলেটিকে দেখে কালকের ঘটনা মনে পড়ে গেল। মন খারাপ হয়ে গেল। ওকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম কি চাই। বলল দশ টাকা। জিজ্ঞেস করলাম দশটাকা দিয়ে কি করবে। ও বলল বিস্কুট কিনবে। দুপুর থেকে নাকি কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। হয়তো ও মিথ্যা বলছে কিন্তু ওসবে না গিয়ে এক প্যেকেট বিস্কুট কিনে ওর হাতে দিলাম। ও চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে ডাক দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম আরও কিছু চাই কি। ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। আরেক বার জিজ্ঞেস করলাম। বলল ওর ছোট ভাইয়ের জন্য চকলেট চাই। দুটো চকলেট কিনে দিলাম। আবার জিজ্ঞেস করলাম আর কিছু লাগবে। ওর চোখ দুটো চমকে উঠলো যেন আজ যা চাইবে তাই পাবে। সাহস করে কিছুই বলছিল না। চোখে চমক নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু বলতে যেন সাহস পাচ্ছে না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম - কি চাই বলো। বলল একটি খেলনা গাড়ি চাই। পান দোকানে ঝুলিয়ে রাখা খেলনা দেখিয়ে দিল। দোকানদারকে বলে কিনে দিলাম। সত্তর টাকার প্লাস্টিকের গাড়ি। ছেলেটি কি খুশি। যেন ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। এক দৌড়ে চলে গেল। ডাক দিলাম। ততক্ষণে ও অনেক দূর চলে গেছে। ছেলেটি খেলনা গাড়ি পেয়ে আমার দিকে চেয়ে যে হাসিটা উপহার দিল এমন হাসি কখনোও দেখিনি। অপুর্ব সুন্দর এক অনুভূতিতে ডুবে গেলাম। পরক্ষনেই মাগরীবের আজানের ধ্বনি কানে আসলো। মসজিদের দিকে রওয়ানা হলাম। আরব সাগর থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগছিল। আজ রাত হয়তো বৃষ্টি হবে।
(২০১৫ সালের একটি লেখা)
Comments
Post a Comment