প্রবাসের ডাক



রচনা কাল ২০১৮ 

প্রবাসের ডাক : ১

ডিগ্রিতে ভালো মার্ক না থাকায় মাস্টার ডিগ্রীটা বোধহয় হবে না এমন একটা ভাব হচ্ছিল। ইগ্নূতেই এডমিশান নিলাম। আসলে ক্লাসে বসে পড়ার ইচ্ছা চলে গিয়েছিল আগেই। তাই এই শর্টকার্ট। আব্বা প্রথমে রাজি ছিলেন না, কিন্তু আমি জোর করায় শেষ পর্যন্ত মানলেন। তখনো সেমিস্টার প্রথা চালু হয়নি। ফার্স্ট ইয়ারেই রেজাল্ট খারাপ। এক প‍্যাপারে বেক আর বাকিগুলোর মার্কস দেখে নিজেরই লজ্জা লাগলো। John Donne এর প্রতি অধিক মোহ আর ব‍্যক্তিগত জীবনে ঐসব মন কেমন করা কবিতার প্রভাব‌ই কাল হলো। রেজাল্টের পরদিন পিসিওতে আব্বার ফোন। একটা জিনিষ লক্ষ্য করছিলাম। যত দিন যাচ্ছে, আব্বার রাগ দূঃখে পরিণত হচ্ছে। আমার ও খুব অনুশোচনা হলো। অজান্তেই কেঁদে ফেললাম। লজ্জা আর অনুশোচনায় ভেঙে পড়লাম। কিছু একটা করতে হবে। পড়াশোনা করব না ছেড়ে দিয়ে কিচ্ছু একটা কাজ করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।দুদিন পর আব্বাকে ফোন করলাম। আব্বা তখন গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগরে। প্লান করলাম গুজরাট ঘুরে আসার। অনেক বাকবিতণ্ডার পর আব্বাকে রাজি করলাম। পড়াশোনা ছেড়ে চাকরি খুঁজব গুজরাটে। এমনিতেও ওপেন স্কুলের ছাত্র। পরীক্ষা ওখান থেকেই দিতে পারবো। আব্বার দাবি একটাই। চাকরি হোক বা না হোক, মাস্টার্স কোর্স টা করতে হবে। মেনে নিলাম। কমসে কম এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। গুজরাট যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।
এতদিন একটা দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি ছিলাম। দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে বোঝাবুঝি সম্ভব হয়নি। রাজনীতিতে জড়িত অনেকের সঙ্গে ভালোই বচসা লেগে আছে। আব্বা বলছিলেন সাংবাদিকতা ছেড়ে দিতে হবে। কম্প্রোমাইজ না করে সাংবাদিকতা করা কঠিন আর মাসের শেষে খরচটাও বেরোয় না। ছেড়ে দিতে হবে এই সব। বিরক্ত লাগছে আর। অনেক বন্ধু বান্ধব ইতিমধ্যে পর ভাবতে শুরু করেছেন। ওদের সঙ্গে বনিবনা হবে না। টাকা খেয়ে নিউজ লেখতে পারব না।
তিন চারদিন পর আব্বা পোস্ট কার্ড পাঠালেন। ক্রমানুযায়ী লিখে দিয়েছেন কি ভাবে গান্ধী নগর পৌঁছতে হবে। করিমগঞ্জ থেকে গুয়াহাটি যেতে হবে নাইট সুপারে। পরদিন সকাল ১০.৩০ টায় গুয়াহাটি থেকে ব্রহ্মপুত্র মেইল দিল্লি অবধি। সময় লাগবে দুই দিন দু্ই রাত। দিল্লি থেকে আহমেদাবাদ মোটামুটি আর‌ও আঠারো ঘণ্টা। চারদিনের যাত্রা।‌ কি কি নিয়ে যেতে হবে, কোথায় কি করতে হবে, আব্বার সাথে আলোচনা করে সবকিছুর লিস্ট বানিয়ে ফেললাম। পরের সপ্তাহের টিকিট কেটে আনলাম। ট্রেনে এতদূর কখনো যাওয়া হয়নি তাই সময় থাকতে সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে।


প্রবাসের ডাক: ২
যাওয়ার দিন যতই কাছে আসছিল তত‌ই উৎসাহ অনুভব করছিলাম। তবে ভবিষ্যত নিয়ে যত আনন্দ তত‌ই চিন্তা হচ্ছিল। মন খারাপ ও ছিল। এতদিনের সব বন্ধুদেরকে ছেড়ে যেতে হবে।
জামা কাপড় সেকেন্ড ইয়ারের ব‌ই আর রাস্তায় লাগার মত খাবার জিনিসপত্রয় দুটো বেগ। আর্মি কেন্টিন থেকে কিনে আনা একটা ভিআইপি স‍্যুটকেস আর একটা পুরনো ডাফল বেগ ভর্তি হয়ে গেল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের তিনটি ব‌ইও নিয়ে নিলাম। জীবন থেকে গল্প কবিতা হয়তো চলেই যাবে। একটা পুরনো ডায়রি হাতে এলো। কলেজে থাকার দিন গুলো মনে পড়ে গেল। সাদা মাটা জীবনেও অনেক বন্ধু ছিল। হয়তো অনেকের সঙ্গে আর দেখা হবে না। ছোট ভাই টলমল চোখে বেগ গুছিয়ে দিচ্ছিল। কান্না সামলাতে পারলাম না।

তিন বছরে ছোট হলেও বন্ধুর মতো থাকতাম। একবার দুই ভাই খেলতে গিয়ে কি কান্ড! কাবাডি খেলছিলাম। পা ভেঙে একমাস ঘরে বন্দি। ডিগ্রি সেকেন্ড ইয়ারের ঘটনা। দিনরাত ও পাশে বসে থাকত। পড়াশোনায় ও খুব ভালো ছিল না। বার‌ইগ্রামে রেল স্টেশনের পাশে মসজিদ রোডে একটা দোকান দিয়েছিল। এলিট বুক শপ। পাঠ‍্যব‌ই আর মনিহারি। সাথে পিসিও। পিসিওতে অনেক ভিড় হতো। লং ডিসটেন্স আর আই এস ডি কল করার জন্য সকাল থেকেই খদ্দের আসতে থাকতেন। কাস্টমার বেশি থাকায় আমিও মাঝে মাঝে দোকানে চলে যেতাম। দোকানের পেছন দিকে ছোট্ট একটা কেবিন ছিল। সন্ধ্যেবেলা নিউজ লেখতাম আর পিসিও থেকে পাঠিয়ে ফেক্স করে সংবাদ দফতরে পাঠিয়ে দিতাম। ধীরে ধীরে সব বন্ধুরা ওখানে এসে আড্ডা দেয়া শুরু করে দিল। জুতো সেলাই থেকে শুরু করে চন্ডীপাঠ নিয়েও আলোচনা হতো। সাংবাদিকতা করতাম তাই খবরের কাগজ ও আসত। সবাই মিলে মাঝরাত অবধি আড্ডা দিতাম। কবিতা আবৃত্তি, গান, গল্প সব‌ই হতো। রেগুলার আড্ডাবাজ দের মধ্যে ছিলেন মৃণাল, মনসুর, নিরুপম, সুমন্ত, পঙ্কজ, সেলিম, সামিম, বাবুল আক্তার, সুবির, মিস্টু এবং আরও অনেক। আমাদের পিসিওর গল্প লিখতে বসলে মহাভারত হয়ে যাবে তাই একটি ছোট্ট ঘটনা লিখে শেষ করব।
তখন আমাদের নব নির্বাচিত বিধায়ক ছিলেন আমাদেরই এলাকার। বার‌ইগ্রামবাসি স্থানীয় বিধায়ক পেয়ে অকস্মাৎ রাজনৈতিক ভাবে খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। বার‌ইগ্রাম দক্ষিণ করিমগঞ্জের রাজধানী হয়ে উঠেছিল। আমাদের দোকানের লাগোয়া দোকান ছিল আমাদের এক প্রতিবেশী দাদার যিনি ঠিকাদারিও করতেন। সেই সুবাদে পিসিওতে অনেক ঠিকাদার মিস্ত্রি আর পঞ্চায়েত স্তরের ছোট খাটো রাজনৈতিক নেতারাও আসতেন। ওরা প্রায়‌ই বিধায়ককে পিসিও থেকে ফোন করতেন। তখন মোবাইলের প্রচলন খুব একটা শুরু হয়নি। আর কল রেট বেশি হ‌ওয়ার জন্য আমাদের পিসিওতে আউটগোয়িং কল থেকে ইনকামিং কল আসত বেশি।
ছোট ভাই যখন আমুদে মেজাজে থাকতো তখন কল আসলেই ফাজলামো করত। ও ফোন উঠিয়ে বলত - বলুন, আমি এম‌এল‌এ বলছি, কাকে চাই? অনেকেই ভয় পেয়ে ফোন রেখে দিত। ভাবতো সত‍্যি‌ই হয়তো এম‌এল‌এর নাম্বারে ফোন লেগে গেছে। একদিন খোদ এম‌এল‌এ ফোন করলেন। ছোট ভাই সেই একই সুরে বলে উঠলো - বলুন আমি এম‌এল‌এ বলছি। অপর প্রান্তে মুহূর্তের নিরবতা। তারপর আসল বিধায়ক বললেন - আচ্ছা তুমি কখন বিধায়ক হলে। জণগন আমাকে ভোট দিল আর তুমি এম‌এল‌এ হয়ে গেলে। ছোটভাই ভয় পেয়ে ফোন রেখে দিল। আমাদেরতো হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার উপক্রম। এর পর‌ ছোট ভাই আর কখনও এমন করত না। কিন্তু বিধায়ক যখন‌ই কোন কাজে ফোন করতেন ছোট ভাইকে মজা করে এম‌এল‌এ বলে সম্বোধন করতেন। পিসিওতে বসে আড্ডা দেয়ার সেই স্মৃতি বড়‌ই নস্টালজিক। জানতাম না বন্ধুদের সঙ্গে এই আড্ডা শীঘ্রই ইতিহাস হতে চলছে।


প্রবাসের ডাক: ৩
যথারীতি আব্বার পোস্টকার্ডে লিখে দেয়া পরিকল্পনা অনুযায়ী Trains at Glance ব‌ইটি কিনে ফেললাম আর নাইট সুপার আর ট্রেনের টিকিট কেটে ফেললাম। কয়েকজন বন্ধু করিমগঞ্জ নাইট সুপার স্টেন্ডে এসে আমাকে বাসে বসিয়ে দিল। করিমগঞ্জ থেকে গুয়াহাটি যেতে হবে আর গুয়াহাটি থেকে পরের দিন সাড়ে দশটার ট্রেন। নাইট সুপার সময়মতো পৌঁছে গেলে‌ই হলো। বাসে ঘুম হলো না। সারা রাত আম্মার কথা মনে আসছিল। বাসের কাঁচের জানালা ভালো করে বন্ধ হচ্ছিল না। ফাঁক দিয়ে বাতাস আসছিল। বাইরে কি ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ লাড্রিমবাইয়ে পৌঁছে রাতের খাবার খেলাম। কি যে অখাদ্য! বাস থেকে নামাই ভুল হয়েছে।
পাঁচটায় খানাপাড়া পৌঁছে গেলাম। আজানের ধ্বনি কানে আসছিল। ইতিমধ্যে ভোরের আলোয় গুয়াহাটির রাতের অন্ধকার বিদায় নিতে চলছে। এইবার নিয়ে সম্ভবত পাঁচ বার গুয়াহাটি আসা হলো। খানাপাড়া থেকে অটো রিক্সা নিয়ে সোজা পল্টন বাজার রেল স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। বাথরুম সেরে চা বিস্কুট খেয়ে নিলাম। সময়মতো ট্রেন এলো। কম্পার্টমেন্ট খুঁজে বের করে নির্ধারিত সিটে বসে পড়লাম। এস-৭ এ আমার ১৮ নম্বর সিট। আমার লোয়ার বার্থে সিট ছিল। কম্পার্টমেন্টে কেবল আরেকজন যাত্রী। ভদ্রলোকের সাইড বার্থে সিট। এছাড়া আর কেউ নেই। এই কোচে যাত্রী খুব কম। একমাত্র সহযাত্রী জানালেন এখন অফ সিজন থাকায় ব্রহ্মপুত্র মেলে খুব একটা ভিড় হয়না। উনার রেলের চাকরি। পাটনায় যাবেন। শিঘ্রই শুয়ে পড়লেন।
হু হু করে ট্রেন চলছিল। বরপেটা রোড ক্রস করলাম। জুন মাস। বাইরে খুব গরম। আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই। ফাঁকা কম্পার্টমেন্টের মতো মনের আকাশ ও খালি খালি লাগছিল। পুরনো সব স্মৃতি একে একে সিনেমার রিলের মতো ভেসে উঠছিল। জীবন মানেই যাত্রা। এখন যেখানে আছি মুহুর্তের পর আরেক জায়গায়। আসলেই কি আমরা জানি এই যাত্রা কত অজানা। কোথায় কাকে নিয়ে যায় কেউ জানে না। শীঘ্রই এক নতুন জায়গায় যাবো। জানিনা কোন কাজ পাবো কি না। হয়ত আবার ফিরে আসতে হবে। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে হবে।
জানালায় বসে বসেই ঘুম পেয়ে গেল। চোখ খুলে দেখি দিনের আলো প্রায় শেষ হতে চলছে। হকারের মুখে জানতে পারলাম ট্রেন জলপাইগুড়ি ঢুকছে। বাইরে লাল আকাশ। সুর্যদেবের বিদায়ের সময়। মাটির কাপে চা কিনে নিলাম। আম্মা চীড়ে ভাজা দিয়েছিলেন। চায়ের সঙ্গে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত দশটা নাগাদ উঠে আরেক বার চা খেলাম। ইতিমধ্যে আমাদের কামরায় এক দম্পতি উঠেছেন। সদ‍্য বিবাহিত মনে হয়। ওরা দিল্লি যাচ্ছেন। দিল্লি পৌঁছতে এখনও তিরিশ ঘণ্টা। শারদীয় নবকল্লোল খুলে বসলাম। মাঝরাত অবধি পাতা উল্টাতে থাকলাম। কখন ঘুম আসল মনে নেই। পরদিন সকালে যখন চোখ খুলে তখন ট্রেন বিহারের নাম না জানা অনেক স্টেশন অতিক্রম করে ছুটে চলছে। বিহারের পর উত্তর প্রদেশ। লক্ষ্য করছিলাম যত‌ই উত্তর ভারতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি গরমের মাত্রা বেড়ে উঠছে। পরের দিন সকালেই দিল্লি পৌঁছে যাবো।
প্রায় দুই ঘণ্টা দেরিতে যখন দিল্লি পৌছি তখন সাড়ে বারোটা বাজছে। আব্বা বলেছিলেন স্টেশনে খেয়ে নিতে। আইআরসিটিসির হোটেলে নিরামিষ ভাত খেয়ে নিলাম ১৮ টাকার বিনিময়ে। আমাকে ১১ নম্বর প্লেটফর্মে যেতে হবে। ওখান থেকে আহমেদাবাদের উদ্দেশ্যে আশ্রম এক্সপ্রেস ছাড়বে সাড়ে তিন টায়।


প্রবাসের ডাক: ৪
দিল্লি থেকে আহমেদাবাদ যেতে সময় লাগবে প্রায় সতের ঘন্টা। হরিয়ানা আর রাজস্থান পেরিয়ে গেলেই গুজরাট। প্রচন্ড গরম। দিল্লি হরিয়ানায় যে এত গরম তা খবরের কাগজে‌ই পড়েছিলাম। রিওয়াড়ি স্টেশনে গাড়ি থামলো প্রায় দশ মিনিট। মনে পড়ল কোথায় যেন পড়েছিলাম "রিওয়াড়ি কি রেউড়ি" বিখ্যাত এক খাবার। স্টেশনে নেমে রেউড়ি খুঁজলাম, পাওয়া গেল না। হয়ত আমার উচ্চারণ ঠিক হচ্ছে না তাই হিন্দিভাষি দোকানদাররা রেউড়ি দিতে পারলেন না। অগত্যা চা আর পকোড়া নিয়ে বসলাম।
সন্ধ্যা হ‌ওয়ার একটু আগে ট্রেন রাজস্থানে প্রবেশ করল। জানালার বাইরে কি সুন্দর দৃশ্য। "হঠাৎ বৃষ্টি" সিনেমায় নচিকেতা চক্রবর্তীর একটি গান আছে - সোনালী প্রান্তরে, ভ্রমরার গুঞ্জনে..."। সিনেমাটি দেখা হয় নি, কিন্তু অস্তমিত সূর্যের আভায় সোনালী প্রান্তর কত সুন্দর হয় দেখলেই বোঝা যায়। যতদূর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। মাঝে মাঝে অর্ধ ভগ্ন প্রাসাদ‌ও দেখা গেল। কখনো কখনো ঘর ফেরত উটের সারি ধুলো উড়িয়ে রাখালের তাড়ায় ঘরে ফিরছে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে। পশ্চিম আকাশে কে যেন লাল সালুর সামিয়ানা বেঁধে রেখেছে। কি দারুন সুন্দর দৃশ্য। পড়ন্ত বিকেলের এই নৈসর্গিক দৃশ্য বর্ণনা করা যাবে না।
এত গরম সহ্য হচ্ছিল না। ট্রেনের জানালা দিয়ে তপ্ত হাওয়া আসছিল। জয়পুর পৌছার আগে নাক দিয়ে রক্ত বের হতে আরম্ভ করলো। সাদা টি-শার্ট লাল হয়ে কি যে অবস্থা। ভয় পেয়ে গেলাম। সহযাত্রীরা বললেন আমি এই গরমের অভ‍্যস্ত ন‌ই তাই এমন হচ্ছে। ভয় করার কিচ্ছু নেই। রাত আটটা নাগাদ ট্রেন জয়পুর পৌঁছে গেল। এই ট্রেনে পেন্ট্রি কার নেই, তা আব্বা আগেই বলে দিয়েছিলেন। স্টেশনে নেমে ভাত খেয়ে নিলাম। রাত এগারোটা অবধি জানালার পাশে বসে রইলাম। এই‌ গরমে ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। বাইরে কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুরে কখন‌ও কোন রাজস্থানি ঘরে জ্বলতে থাকা আলো দেখা যাচ্ছে আর নিমেষেই আবার অন্ধকারের বুকে ডুবে যাচ্ছে ট্রেইন। হয়তো ৮০/৯০ কিলোমিটার গতিবেগে গাড়ি চলছে। অনেক রাত অবধি বসে রইলাম। সকাল ৮ টার মধ্যেই আহমেদাবাদে পৌঁছে যাব। কথামত ৭ নম্বর প্লেটফর্মে হয়ে বাইরে গেলেই সিআরপিএফ ট্রেনজিট কেম্পের সাইনবোর্ড দেখতে পাব। প্রায় ছয়মাস পর আব্বার সাথে দেখা হবে।
সকাল আটটার একটু আগেই আহমেদাবাদ পৌঁছে গেলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্রেনজিট কেম্প খুঁজে বের করলাম। স্টেশনের লাগোয়া ট্রেনজিট কেম্প আসলে একধরনের অপেক্ষা গৃহ। সবধরনের সেনাবাহিনী বা অর্ধ সামরিক বাহিনীর এমন ব‍্যবস্তা থাকে যাতে সেনাকর্মিরা যাত্রাপথে প্রয়োজনে বিশ্রাম নিতে পারে। উন্নত মানের হোটেলের মত সব ব‍্যবস্তা এমনকি মেডিকেল সেন্টার ও আছে। ট্রেনজিট কেম্প থেকে দুরদুরান্তে অবস্থিত ছোট ছোট শহরে যাওয়ার জন্য বাস বা জীপের ব‍্যবস্তা থাকে।
দুর থেকে আব্বাকে দেখতে‌ পেলাম। গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সালাম করে উনার সাথে সিকিউরিটি চেক গেটে গেলাম। ফর্মালিটি শেষ করে আমাকে কেন্টিনে নিয়ে গেলেন। আব্বার সঙ্গে নাস্তা করলাম। গুজরাটি প্রাতঃরাশ। কড়ির সংগে ঢোকলা, ফাফড়া আর চা। খুব স্বাদের খাবার। ট্রাঙ্ক কল করে ছোট ভাইকে আমার পৌঁছানোর খবর দিয়ে দিলাম। আব্বার সঙ্গে এক ঘন্টা এদিক ওদিক ঘুরে দেখলাম। ট্রেনজিট কেম্পের ভিতরেই কি সুন্দর একটা বাগান। নানা রংয়ের ফুল ফোটে আছে। জীবনে প্রথম ময়ূর পাখি দেখলাম। ভয়হীন ভাবে দিব‍্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্তত দশটি ময়ূর ময়ূরী। প্রথম বার টাইমস অব ইন্ডিয়া খবরের কাগজ হাতে নিয়ে পড়লাম। এরপর একটুখানি বিশ্রাম নিয়ে বারোটার সময় আমরা জীপে বসলাম। গন্তব্য গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগর।


প্রবাসের ডাক: ৫
আমাদেরকে গান্ধী নগর যেতে হবে। আব্বা বললেন এখান থেকে বাইপাস হয়ে গান্ধী নগর প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূর, সময় লাগবে প্রায় এক ঘন্টা। আহমেদাবাদ শহরের উঁচু উঁচু অট্টালিকা দেখলেই বোঝা যায় এই শহর অনেক উন্নত। কয়েক বছর আগের দাঙ্গার কোনো চিহ্ন নেই। মানুষ হয়তো সাময়িক ভাবে ভুলে গেছে সব। এরাজ্যের জনগণ মুলত ব‍্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মহারাষ্ট্রের পর উন্নততর রাজ‍্যের মধ্যে গুজরাটের স্থান দ্বিতীয়। শহর ছেড়ে আহমেদাবাদ এয়ারপোর্ট চোখে পড়লো। এরপর সবরমতী নদীর উপর বানানো ইন্দিরা ব্রীজ পার হলাম। সবরমতী এখন খটখটে শুকনো। আব্বা বললেন কেবল বর্ষার কয়েক মাস নদীতে জল হয়। এরপর ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। জীপের জানালা খুলতেই গরম হাওয়া লাগলো। একে লু হাওয়া বলা হয়। মরুভূমিতে এই লু হাওয়া প্রাণঘাতী হয়। তাই এত গরমেও পুরো শরীর ঢেকে কাপড় পরতে হয়।
আহমেদাবাদ থেকে গান্ধী নগর যাওয়ার সড়ক খুবই মনোরম। ছয় লেনের রাস্তা। এমন রাস্তা জীবনেও দেখিনি। ফিনফিনে পরিস্কার সড়ক। দুই দিকে দুটি করে সমান্তরাল লেইন। বাস আর কারের জন্য ননস্টপ লেইন। দেখলাম সব গাড়িই নিজের নিজের লেইনে চলছে। ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে যাচ্ছে। অনেক বিদেশী গাড়িও চোখে পড়ল। একটাও খাদ বা গর্ত চোখে পড়লো না। এমন সুন্দর রাস্তা আমাদের অসমে কল্পনা করা যায় না। আমি হতবাক হয়ে চোখ ভরে দেখে নিচ্ছিলাম। "ওয়েল কাম টু ক্লিন এন্ড গ্রীন গান্ধীনগর" বোর্ড দেখে মানতেই হবে ‌সত্যিই সবুজ আর পরিচ্ছন্ন এই শহর।
গুজরাটের রাজধানী গান্ধী নগর এক পরিকল্পিত নগরী। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ষাটের দশকে এই শহরের গোড়াপত্তন করেন। পাঞ্জাবের রাজধানী চন্ডিগড়ের আদল অনুকরণ করে বানানো হয়েছে। মোটামুটি চল্লিশ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে মোট ত্রিশটি সেক্টরে বিভক্ত গান্ধী নগর। প্রতিটি সেক্টরে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয়, শপিং সেন্টার, খেলার মাঠ, ব‍্যায়ামাগার, জগিং ট্রেক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পার্ক ইত‍্যাদি আছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য সেক্টর ঊনত্রিশ, বেঙ্ক আর অন‍্যান‍্য কমার্শিয়াল প্রতিস্ঠানের জন্য সেক্টর ষোলো, রাজধানী আর সচিবালয়ের জন্য সেক্টর এগারো আলাদা ভাবে বরাদ্দ। বাকি সেক্টর গুলোতে সাধারণ মানুষ বসবাস করেন। ছবির মতো সাজানো গোছানো সুন্দর এই শহর। ভীড় নেই, নেই ট্রাফিক জ্যাম। শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে সবাই মিলে মিশে থাকেন।
গান্ধীনগরের দক্ষিণ প্রান্তে শহর ছাড়িয়েই শুরু হয়ে গেছে সেনা ছাউনি। সেক্টর ত্রিশ থেকে চিলোডা বাজার যাওয়ার রাস্তার দুই পাশে ভারতীয় স্তল সেনা, সীমা সুরক্ষা বাহীনি আর কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত সেনার ওয়েস্টার্ন কমান্ড জোন। রাস্তার বামদিকে মোটামুটি পাঁচশ একর এলাকা জুড়ে সিআরপিএফ গ্রুপ সেন্টার। এখানে চারটে হেড কোয়ার্টারস, রিক্রুটমেন্ট অফিস, ট্রেনিং সেন্টার, স্টেডিয়াম আর আবাসিক ছাউনি। আব্বা ১৩৫ ব‍্যাটালিয়ানে কাজ করেন। মটর ট্রেনসপোর্ট বিভাগে উনি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। যখন কেম্পে পৌঁছি তখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল। বিরাট গেইট পেরিয়ে সোজা চলে গেলাম আমাদের নির্ধারিত কোয়ার্টারে। হাউস নং বি-১১৭, টাইপ এ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, টেগোর মার্গ। দুতোলায় দুটি রুম, একটি বসার ঘর, রান্না ঘর আর বেলকনি। একটি রুমে আব্বা থাকেন আর অন্য রুমটিতে আপাতত আমি থাকব। একখানা সিঙ্গল বেড, চেয়ার টেবিল, একটি গোদরেজ আলমারি আমার আসবাবপত্র। রুমটিতে একটি বড় জানালা আছে। খুলে দিলেই চোখে পড়ে স্পোর্টস ট্রেনিং গ্রাউন্ড। আমি কাপড়চোপড় খুলে স্নান করে নিলাম। এত দুর সফর করে ক্লান্ত ছিলাম। শুয়ে পড়লাম।


প্রবাসের ডাক: ৬
সন্ধ্যায় আব্বার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। আমাকে উনার অফিসে নিয়ে গেলেন আর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার খাওযার ব‍্যবস্তা আব্বার সঙ্গেই মেসে করা হয়েছে। সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট, দুপুর দুটোর সময় লাঞ্চ, সন্ধ্যা ছয়টায় বিকেলের চা আর রাত নয়টায় রাতের খাবার। আব্বা বললেন আমি যাতে সময় মতো মেসে গিয়ে খেয়ে নেই কারণ উনি কখনো বাইরে যান আর কাজের চাপ থাকলে প্রায়‌ই উনাকে অফিসেই টিফিন পৌঁছে দেয়া হয়। কেম্পে কোথায় কি পাওয়া যায় আর কি কাজে কোন যায়গায় যেতে হয় বুঝে নিলাম। ক্লান্ত ছিলাম তাই রাতে খুব গভীর ঘুম এলো।
গান্ধী নগর আসার দুটো উদ্দেশ্য ছিল। জীবনের প্রথম বাইরে বেড়ানো হয়ে যাবে আর প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি খুঁজব। সম্বল একটি ডিগ্রি আর একবুক আশা। ছোট থেকেই আমার কাকা আমাকে ইংরেজি শেখাতেন। তাই বেসিক কম‍্যুনিকেশন স্কিলস আমার খুব একটা খারাপ ছিল না। পরের দিন সকালে উঠে আব্বার অফিস গেলাম। আব্বা উনার এক সহকর্মী অরুণ শর্মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। উনি আইটি বিশেষজ্ঞ। আমার বায়োডাটা বানিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক গুজরাটি তাই আমাকে আহমেদাবাদ আর গান্ধী নগর সম্পর্কে কিছু তথ্য দিলেন। বেড়ানোর জন্য কোন জায়গা গুলো বিখ্যাত, চাকরি কোথায় খুঁজতে হবে, আহমেদাবাদে বা গুজরাটের অন্যান্য শহরে যেতে হলে কোথায় বাস বা ট্রেন পাওয়া যাবে ইত‍্যাদি। উনার উপদেশ অনুযায়ী আব্বাকে বলে টাইমস অব ইন্ডিয়া খবরের কাগজ সাবস্ক্রাইব করলাম। হকার রোজ সকালে কোয়ার্টারে দিয়ে যাবে।
প্রথম সপ্তাহ খুব সাদামাটা কাটলো। ইন্সপেক্শনের জন্য আব্বা ব‍্যস্ত ছিলেন। আমি সারা দিন গ্রুপ সেন্টার ঘুরে বেড়াতাম। লাইব্রেরীতে বই পড়তাম, বিকেলে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখতাম আর রাতে থিয়েটারে গিয়ে নাটক দেখতাম। রোজ সন্ধ্যায় কেম্পে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান থাকত। মাঝখানে দুই তিন বার আহমেদাবাদ ঘুরে আসলাম। একদিন হিম্মতনগরও ঘুরে আসলাম। আব্বার কোন সহকর্মী বাইরে গেলেই আমাকে নিয়ে যেতেন। রোজ তন্ন তন্ন করে নিউজ পেপার পড়তাম আর দেখতাম কোথাও কোনো চাকরির বিজ্ঞাপন আছে কি না। বিজ্ঞাপন অনেক থাকত কিন্তু আমার বায়োডাটার সাথে ম‍্যাচিং কিচ্ছু পাওয়া যেত না। প্রায় পনের বিশ দিন পর একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো। আহমেদাবাদ আইআইএম‌এ একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে আউটসোর্সিং ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে বড় মাপের সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। বিজ্ঞাপনে লেখা আছে যারা বিপিও সেক্টরে চাকরি করতে ইচ্ছুক তারাও যেতে পারেন। অনেক প্রাইভেট কোম্পানি জব ফেয়ারেও যোগ দেবে। তখন আজকের মতো ইন্টারনেট এক্সেস সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু এটা জানতাম যে স্নাতক ডিগ্রি থাকলে আর ভালো ইংরেজি বলতে পারলে সহজেই বিপিওতে চাকরি পাওয়া যায়। আব্বার সঙ্গে আলোচনা করলাম। পরের দিন আহমেদাবাদে যেতে হবে।
আহমেদাবাদে একা যেতে হবে। গান্ধী নগর পথিকাশ্রম থেকে স্টেট ট্রেনস্পোর্টসের বাস পাওয়া যাবে। পথিকাশ্রম মূলতঃ গান্ধী নগরের কেন্দ্রীয় বাস ডিপো। আব্বাকে কাজের জন্য বাইরে যেতে হয়েছিল। তাই উনার সহকর্মী ধরমপাল সিং আমাকে উনার বুলেটে বসিয়ে বাস স্টপে পৌঁছে দিলেন। ডিজেল চালিত ঐ বুলেটের বিকট শব্দ কান ঝালাপালা করে দিত।


প্রবাসের ডাক: ৭
বারো টাকার টিকিট কেটে এসটি বাসে বসলাম। প্রখর রোদে আগাগোড়া লৌহ নির্মিত বাসে আহমেদাবাদ যেতে হবে। আমাকে নামতে হবে আশ্রম রোডে টাইমস অব ইন্ডিয়া বাসস্টপে। লক্ষ্য করলাম গরমে আমিই নাজেহাল হচ্ছি। বাকি যাত্রিরা আরামসে বাসে সফর করছেন। ভাবলাম একদিন আমিও এই গরমে অভ‍্যস্ত হয়ে যাবো‌। চল্লিশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। আশ্রম রোড থেকে অটো নিয়ে যেতে হবে আইআইএম রোডে। ওখানেই আছে অল ইন্ডিয়া মেনেজমেন্ট এসোসিয়েশনের অফিস। সময় মতো পৌঁছে গেলাম। গেট পেরিয়ে দেখলাম অনেক দেশি বিদেশি কোম্পানি স্টল খুলে রেখেছে। আসলে জব ফেয়ার চলছে। আইবিএম, এক্সেন্চিওর, ইনফোসিস ডাব্লিউএন‌এস, উইপ্রো ইত‍্যাদি কোম্পানি তাদের নির্ধারিত স্টলে ইচ্ছুক প্রার্থীদের নিয়ে কাউন্সেলিং করছে। বেশিরভাগ কোম্পানিতে আবার কল সেন্টার বা বিপিও সেক্টরে কাজ করার অভিজ্ঞতা চাই। কিছু কোম্পানি কিন্তু নবাগতদেরকে‌ও সুযোগ দিচ্ছে। এমন‌ই কয়েকটি কোম্পানিতে বায়োডাটা জমা দিলাম। কয়েকটিতে আবার ফর্ম পূরণ করতে হলো। কোম্পানির প্রতিনিধিরা বললেন, আমার বায়োডাটা শর্ট লিস্ট হলে ইন্টার্ভিউয়ে ডাকা হবে। আব্বার অফিসের নাম্বার দিলাম।
কিছুক্ষণ পর মাইকে ঘোষণা হলো শীঘ্রই মেইন প্রেক্ষাগৃহে সেমিনার চালু হতে যাচ্ছে। আমিও গিয়ে হলের পেছনের দিকে একটি চেয়ারে বসে পড়লাম। একে একে বিভিন্ন কোম্পানির কর্মকর্তারা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আলোচনা করলেন। সবাই ইংরেজিতে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বেশিরভাগ মাথায় ঢুকছিল না। এতটুকু বোঝলাম যে বিপিও সেক্টর অনেক বড় হতে চলছে। বড় বড় আমেরিকার কোম্পানি ওদের টেলিসেইলস্, কাস্টমার কেয়ার, টেকনিক্যাল সাপোর্ট ইত‍্যাদি বিভাগ আজকাল ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আউটসোর্সিং করছে। কারণ দুটো - খরচের সাশ্রয় আর গুণগত মান। মুম্বাই থেকে আসা এক কোম্পানির প্রতিনিধি বললেন - যারা এই ইন্ডাস্ট্রিতে আসতে চায় তাদেরকে ইংরেজিতে বাকপটু হতে হবে। ২৪ ঘন্টা চলতে থাকা পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। প্রায়ই রাতের শিফটে কাজ করতে হবে তাই ফ্লেক্সিবল হ‌ওয়া জরুরি। শুরুতে ৫ থেকে ১০ হাজার বেতনে সহজেই কল‌ সেন্টারে চাকরি পাওয়া যায় । ভালোভাবে কাজ করতে পারলে বোনাস পাওয়ার সুযোগ থাকে।
বুঝতে পারলাম আমার ইংরেজি কথোপকথন শুধরে নিতে হবে। যদি ভাগ‍্য ক্রমে কোথায় চাকরি পেয়ে যাই তবে টেলিফোনে বিদেশি লোকদের সঙ্গে বিশেষ করেন আমেরিকান বা বিলাতি লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারা প্রয়োজন। আমার কাছে এসব স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করায় তেমন ভালো ইংরেজি ক‌ই আর পারি। তবুও ভাবলাম স্পোকেন ইংলিশ শিখে নিতে পারবো। হয়ত সময় লাগবে কিন্তু ইংরেজি জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তা বুঝতে পারলাম।
দীর্ঘ বক্তব্যের পর দুপুরের খাবারের জন্য বিরতি দেয়া হলো। হলেই ভলান্টিয়াররা খাবারের পেকেট দিলেন। সমোসা মিস্টি আর চকলেট। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হলো। প্রার্থীদের নানা ধরনের প্রশ্নের জবাব দিলেন এআইএম‌এর কর্মকর্তারা। অনেক কিছু জানতে পারলাম। ঠিক করে নিলাম বিপিওতেই চাকরি খুঁজতে হবে। ইংরেজি ঠিক করে নিয়ে চাকরি পেলেই সহজে টাকা পয়সা কামানো যাবে। একজন বক্তা বলেছিলেন আগামী বিশ বছর ভারতে বিপিও কোম্পানি রমরমিয়ে চলবে। অনুস্ঠান শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আমার পাশের চেয়ারে বসা একজন প্রার্থীর সঙ্গে কথা হলো। ওর বাড়ি আহমেদাবাদের নবরংপুরা অঞ্চলে। নাম কুনাল পাঞ্চাল। গত মাসেই ওর গ্রেজুয়েশন শেষ হয়েছে। ও বাইক নিয়ে এসেছিল। আমাকে ও বাসস্টপে ছেড়ে দিবে বললো। ওখান থেকে বেরিয়ে লো গার্ডেন নামক স্থানে আমরা চা খেলাম। এরপর কুনাল আমাকে গান্ধীনগরের বাসে বসিয়ে দিল। কুনাল আমার ফোন নম্বর নিতে চেয়েছিল কিন্তু আমার মোবাইল ফোন ছিল না। আমিই ওর নাম্বার নিয়ে নিলাম।
গান্ধী নগর যখন পৌঁছি তখন রাত আটটা বেজে গেছে। বাসস্টপ থেকে অটো নিয়ে নিলাম। গ্রুপ সেন্টারে পৌঁছে দেখি আব্বা গেটেই দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝতে পারলাম উনার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। আমি যদি রাস্তা হারিয়ে ফেলি। তখন তো আর মোবাইল এত বেশি চালু হয়নি। আব্বা বললেন একটি মোবাইল কিনে নেয়াই ঠিক হবে। ভাত খেয়ে আব্বাকে সেমিনারের বিষয়ে সব বললাম। আমার উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে উনি খুব খুশি হলেন। বললেন চেষ্টাই আমাদের কাজ। ফল নিশ্চয়ই আসবে। ক্বাজা নামাজ আদায় করে যখন শুতে গেলাম তখন মাঝরাত। টিভিতে ইন্ডিয়া ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল কিন্তু ক্লান্ত থাকায় দেখা হলো না।


প্রবাসের ডাক: ৮
আসলে আমার মুল সমস্যা ছিল ইংরেজি উচ্চারণ। গ্রামারে বা ইংরেজি লেখায় অসুবিধে হতো না। এম ই স্কুল থেকে আমার মাস্টার চাচা আমাকে ব‍্যাকরণ শিখিয়ে আসছিলেন। টেন্স আর পার্টস অব স্পিচ শিখতে কম মার খাইনি। উনার অক্লান্ত চেষ্টা আর নিয়মিত সহায়তার জন্য ইংরেজিতে মোটামুটি ভালোই মার্কস পেতাম।
ক্লাস ফাইভ-সিক্স থেকেই ব‌ই কেনা আর পড়ার অভ্যাস চালু হয়ে গিয়েছিল। গল্প উপন্যাস ভালো লাগতো। পয়সা জমা হলেই করিমগঞ্জের স্টূডেন্টস লাইব্রেরীতে চলে যেতাম আর বাজেট অনুযায়ী ব‌ই নিয়ে আসতাম। স্বপন কুমারের দীপক চ্যাটার্জি আর রতনলালেব কাহিনী ছিল অল টাইম ফেভারিট। চাচা চৌধুরীর কমিকস ও পছন্দ করতাম। এগুলো আমাকে এক ভদ্রলোক সাপ্লাই করতেন। উনার নাম মনে নেই। দুর্লভছড়া ট্রেনে উনি হকার ছিলেন। মাসে অন্তত একবার বার‌ইগ্রাম স্টেশনে গিয়ে উনার কাছ থেকে স্বপন কুমারের ব‌ই কিনে নিয়ে ‌আসতাম। আমাকে উনি খুব স্নেহ করতেন তাই ডিসকাউন্ট দিতেন আর নতুন বই এলেই আমার জন্য এক কপি রেখে দিতেন। উনার কথা ভুলব না। পড়ার অভ্যাস গড়ার পেছনে উনার অনেক অবদান আছে। সাহিত্যের স্বাদ মুলত উনার জন্য‌ই পেয়েছিলাম।
আনন্দ পাবলিশার্সের ব‌ই কেনা এক স্বপ্ন ছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বিমল কর ইত‍্যাদি লেখকদের বই গুলো আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশ করতো। কিন্তু দাম খুব বেশি হ‌ওয়ায় কিনতে পারতাম না। দেব সাহিত্য কুঠির থেকে ভিপি পোস্টের মাধ্যমেও ব‌ই কিনতাম। কবিতার স্বাদ্ তখন‌ও পা‌ইনি। গোয়েন্দা কাহিনী আর প্রেমের গল্প মন ছুঁয়ে যেত। নীললোহিতের উপন‍্যাস থেকে ধীরে ধীরে কবিতার প্রতি মোহ জাগলো। কবিতা সমগ্র কেনা শুরু হয়ে গেল।
আম্মা এসব ব‌ইকে বাজে ব‌ই বলে ভাবতেন। পাঠ‍্য ব‌ইয়ের নিচে লুকিয়ে রেখে গল্প কবিতার বই পড়তাম। আব্বা এতে কোন বাধা দিতেন না। ক্লাস নাইন টেন পাওয়ার পর আব্বা আমাকে রিতিমত ব‌ই কেনার জন্য আলাদা ভাবে টাকা দিতেন। এর মধ্যেই দুটো বড় বাক্স ব‌ইয়ে ভরে গিয়েছিল। আব্বা আমাকে কাঠের একটি বড় র‍্যাক বানিয়ে দিয়েছিলেন ব‌ই রাখার জন্য।
ম‍্যাগাজিন পড়ার শখ‌ও খুব ছিল। শুকতারা, নবকল্লোল, আনন্দলোক, দেশ ইত‍্যাদি মেগাজিন ছিল খুব প্রিয়। ক্লাস টেন পাওয়ার পর হিন্দি উপন্যাস আর অসমিয়া ম‍্যাগাজিনের প্রতি আকৃষ্ট হ‌ই। হিন্দি উপন্যাস জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আমার প্রিয় রফিক চাঁচা। আব্বার খুড়তুতো ভাই রফিক চাঁচা ডিমাপুরে ঠিকাদারের কাজ করতেন। মুলত উনি আসাম রা‌ইফেলসের বিল্ডিং এর কাজ দেখতেন। উনি ছোটবেলায় ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে ডিমাপুরে পড়াশোনা করেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করায় উনার হিন্দি খুব ভালো ছিল। উনি বেদ শর্মা আর প্রেমচন্দের উপন্যাস নিয়মিত কিনে আনতেন আর পড়া হয়ে গেলে আমার জন্য রেখে দিতেন। দু-তিন মাস পর যখন বাড়ি আসতেন তখন সব ব‌ই আমার জন্য নিয়ে আসতেন । আমি ঐ সব হিন্দি উপন্যাস পড়া শেষ করে দুর্লভছড়া ট্রেনে ব‌ই বিক্রি করা ভদ্রলোককে দিয়ে আসতাম। বিনিময়ে উনার কাছ থেকে নতুন প্রকাশিত বই বা ম‍্যাগাজিন নিয়ে আসতাম।
যখন উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য করিমগঞ্জ কলেজে যাওয়া আরম্ভ করি তখন নাগ বুক স্টোর এ অসমিয়া ম‍্যাগাজিন দেখতে পাই। রহস্য, বিস্ময় আর মায়া এই তিনটি উপন্যাস প্রত্যেক মাসে কিনে আনতাম। অসমিয়া সাহিত্য সত‍্যিই অভাবনীয়। কবিতা আর গল্প মন ছুঁয়ে যেত। আমার প্রিয় লেখকদের তালিকায় রঞ্জু হাজারিকা, মামনি রয়ছম গোস্বামী, নবকান্ত বরুয়া, রজনীকান্ত বরদলৈর নাম চিরদিন থাকবে। আউট ব‌ই বেশি পড়ার জন্যই আমার হিন্দি আর অসমিয়া ভালোই রপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
হায়ার সেকেন্ডারির পর ইংরেজি মেজর নিয়ে বদরপুরের নবীন চন্দ্র কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হলাম। পরিচয় হলো ইংরেজি সাহিত্য জগতের সঙ্গে। শেক্সপিয়ার থেকে আরম্ভ করে মার্ক টোয়েন হোক আর মিল্টন থেকে শুরু করে জেমস্ জয়েসের কবিতা হোক সব উপভোগ করতাম। ইংরেজির প্রতি মোহ আগেই ছিল। সহপাঠী তথা শিক্ষকদের সঙ্গে ইংরেজিতে বার্তালাপ করায় ভাষাগত দক্ষতা হলো।
কিন্তু এখন গান্ধীনগরে বসে এটাই বুঝতে পারছি যে আমার ইংরেজি উচ্চারণ ভয়াবহ হাস‍্যকর। বিপিওতে চাকরি করতে হলে এই ইংরেজি চলবেনা। মাদার টাং ইনফ্লুয়েন্স‌ই কাল। আমাকে নিউট্রেল উচ্চারণ আয়ত্ত করতে হবে। এর জন্য প্রেকটিসের দরকার। অথবা কোথাও স্পোকেন ইংলিশের কোর্স করতে হবে। নিশ্চয়ই গান্ধী নগরে কোচিং সেন্টার থাকবে। খবর নিয়ে এডমিশান নিতে হবে।


প্রবাসের ডাক: ৯
এরমধ্যে আব্বার আরেক সহকর্মীর এস কে‌ আস্থানার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। উনার আসল বাড়ি রাজস্থান। প্রায় পাঁচ বছর থেকে উনি গান্ধী নগরে পরিবার নিয়ে থাকেন। এক রবিবার দুপুরে উনি আমাকে মধ‍্যান্হ ভোজনের নিমন্ত্রণ দিলেন। সেক্টর পাঁচে উনার ভাড়াঘরে খেতে গেলাম। উনি নিরামিষাশী তাও কম মসলা ব‍্যবহার করেন। তাই স্বাদ পেলাম না। কিন্তু উনার ঘরে যাওয়ায় ফায়দা হলো। উনার এক বন্ধু মুকেশ কুমারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মুকেশ বাবু গান্ধী নগরে একটি জব কনসালটেন্সি কোম্পানি চালান। আমি কল সেন্টারে চাকরি খুঁজছি জেনে আমাকে সাহায্য করবেন বলে জানালেন। উনার নাম, মোবাইল নাম্বার আর অফিসের ঠিকানা লেখা কার্ড দিলেন।
পরের দিন চলে গেলাম গান্ধী নগরের এগারো সেক্টরে সুমন টাওয়ারে থাকা উনার অফিসে। ভদ্রলোক আমার ইন্টার্ভিউ নিলেন। বললেন যদিও আমার উচ্চারণে অনেক ভুল আছে তবুও চেষ্টা করতে থাকলে একদিন ঠিকই চাকরি পেয়ে যাব। উনি জানালেন দুদিন পর উইপ্রো কোম্পানি মুম্বাই থেকে টেলিফোনে ইন্টারভিউ কন্ডাক্ট করবে। আমিও ইন্টারভিউ দিতে পারব। উনি আমাকে কিছু টিপস দিলেন। সবচেয়ে প্রথম প্রশ্ন করা হয় - টেল মি এবাউট ইয়রসেলফ। মানে নিজের বিষয়ে বলতে হবে। এই প্রশ্নের উত্তর যদি গুছিয়ে দিতে পারা যায় তবেই কেল্লা ফতে। সাধারণত সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী উত্তরে কি বলা হচ্ছে তাতে আগ্রহী থাকেন না বরং কি ভাবে প্রার্থী কথা বলছে সেই দিকে খেয়াল রাখেন। তাই হোয়াট টু স্পিক থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হাও টু স্পিক। মুকেশ বাবু আমাকে কাগজে লিখে দিলেন কিভাবে নিজেকে ইনট্রোডিউস করতে হয়। প্রথমে নাম ঠিকানা, পরিবারের কে কে আছেন, পড়াশোনা কি করেছি, আমার শখ কি কি, কোন কাজের অভিজ্ঞতা আছে কি না ইত্যাদি অনর্গল ভাবে বলে যেতে হবে। শুদ্ধ গ্রামার হ‌ওয়া বাঞ্চনীয়। উচ্চারণ স্পস্ট আর বোধগম্য হতে হবে। এতটুকু ঠিকঠাক হয়ে গেলেই সিলেক্সন হয়ে যাবে। এরপর চাকরিতে যোগ দিয়ে ট্রেইনিং নিতে হবে। মুলত ঐসব ট্রেইনিং স্বল্প মেয়াদী থাকে। ইংরেজি উচ্চারণ আর কমিউনিকেশন স্কিল শেখানো হয়। পাশ করতে পারলে প্রডাক্ট ট্রেইনিং দেয়া হয় আর চাকরি নিশ্চিত হয়ে যায়। আমি এতসব জানতে পেরে খুব খুশী হলাম। উনি আমাকে কেম্পে গিয়ে ভালো করে চর্চা করতে বললেন। দুদিন আমাকে খুব ভালো প্রেকটিস করতে হবে। কেম্পে এসে আব্বাকে সব বললাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার চাকরি হয়ে যাবে।
পরের দিন আম্মার সাথে কথা হলো। উনি বারবার বললেন আমার যাতে নামাজ আর তেলাওয়াত মিস না হয়। আম্মা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে মন খারাপ হয়ে গেল। বাড়ির সবাই বিশেষ করে বন্ধুদেরকে খুব মিস করছিলাম। একবার মনে হলো এখানে আসাই ভুল হয়েছে। মিছেমিছি বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতাম। চাকরি না পেলে টিউশনি করে চলতে পারতাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এ আমি কি ভাবছি। রাজনেতিক পরিবেশে আমিতো বিরক্ত হয়েই গুজরাটে এসেছি। নাঃ আমি গুজরাটেই কিচ্ছু একটা করব।
পরের দিন চলে গেলাম মুকেশ আঙ্কেলের অফিসে। আমার ইন্টার্ভিউয়ের সময় ছিল বিকেল তিনটায়। যথারীতি আমাকে একটি কেবিনের ভেতরে বসানো হলো। মুম্বাইয়ে অবস্থিত উইপ্রোর অফিস থেকে কল এলো। গুরুগম্ভীর গলায় অপর দিক থেকে একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন - টেল মি এবাউট ইয়রসেলফ। উত্তেজনা আর ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছিল। বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলাম। এক মিনিট বলতে না বলতেই ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন উনি কিচ্ছু বুঝতে পারছেন না। আমাকে ধীরে ধীরে আরেকবার বলার সুযোগ দিলেন। উনি আবার আমাকে থামিয়ে দিলেন। উনি বিলকুল বুঝতে পারছেন না। আমার উচ্চারণ অস্পষ্ট আর ভুলে ভরা। আমাকে আমার বাড়ি কই জিজ্ঞেস করলেন। বললাম অসমের করিমগঞ্জে। উনি আমাকে উপদেশ দিলেন যে আমাকে প্রেকটিস করতে হবে। আর বেশি বেশি করে ইংরেজি সিনেমা দেখতে হবে। উচ্চারণে জড়তা থাকলে চলবে না। আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলা বাঞ্চনীয়। আমি উনার সব উপদেশ একটুকরো কাগজে লিখে নিলাম। উনি বললেন যদি ভালো করে চর্চা করে ইংরেজিতে কথা বলা শিখতে পারি তবে তিন মাস পর আবার ইন্টার্ভিউয়ে আসতে পারি।

মন খারাপ হয়ে গেল। আমার পারফরম্যান্স এত খারাপ হবে ভাবতে পারিনি। খুব নিরাশ হয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কেম্পে ফিরলাম। আব্বা বললেন এসব কিচ্ছু নয়। প্রথম ইন্টারভিউয়ে চাকরি হয়ে যাবে এমন কোন কথা নয়। উনি বললেন টিভিতে রোজ দু-তিন ঘন্টা ইংরেজি অনুস্ঠান দেখে নিতে। আর চাকরি না হলেও চিন্তা করার দরকার নেই। অনেক সময় আছে, নিশ্চয়ই অনেক সুযোগ আসবে। আব্বার কথা মেনে নিয়ে স্বান্ত হলাম। তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। প্রেকটিস করতে হবে। একদিন না একদিন ঠিকই কল সেন্টারে চাকরি করব। আব্বার এক সহকর্মী ঐদিন ঘরে‌ই মাংস রান্না করেছিলেন। আমার ভালো লাগছিল না। আম্মার হাতের রান্না মনে পড়ছিল।


প্রবাসের ডাক: ১০
উইপ্রোয় চাকরি না পেয়ে প্রথমে ভাবছিলাম আমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। খানিকটা ভেঙ্গে পড়েছিলাম। আব্বা বিষয়টি বুঝতে পেরে আমাকে বললেন যারা বিপিওতে চাকরি করছে তারাও আমার মতো। সবাই একসময় জানে না, পরে শিখে নেয়। আমার‌ও চেষ্টা করা উচিত। চেষ্টা করে দেখতেই পারি। কিন্তু যেহেতু আমাদের ভাগ্য স্রস্টার হাতে তাই মন খারাপ করা অর্থহীন। সাফল্যের চাবিকাঠি পরিশ্রম আর চেষ্টা।
আমিও লেগে গেলাম। আমার সমস‍্যাগুলোর তালিকা বানিয়ে ফেললাম।
১) উচ্চারণ
২) অস্পষ্টতা এবং জড়তা
৩) কথ‍্য ভাষায় ব‍্যবহৃত শব্দের ব্যবহার।
সাধারণত আমার মতো বাংলাভাষী প্রার্থীদের মুল সমস্যা মাদার টাং ইনফ্লুয়েন্স‌ বা এমটিআই। এর মানে ইংরেজি কথোপকথনে মাতৃভাষার ছাপ। সব ভাষায় উচ্চারণে জিহ্বা ও কন্ঠের ব‍্যবহার আলাদা। যখন আমরা অন‍্য ভাষার শব্দ উচ্চারণ করি তখন নিজের অজান্তেই নিজের মত উচ্চারণ করি। এক‌ই ভাবে যখন একজন ব্রিটিশ বা আমেরিকান কথা বলেন তখন ওদের উচ্চারণ আমাদের সহজে বোধগম্য হয়না। কারণ আমরা এদের কথোপকথন শুনার পরিবেশ পাই না। আর আমরা যখন ইংরেজিতে কথা বলি তখন ওরা বুঝতে পারে না। অনেক শব্দ সঠিক ভাবে উচ্চারণ না করলে শুনতেও কর্কশ বা হাস‍্যকর হয় তা কেবল যারা ইংরেজিতে বাকপটু তারাই বুঝতে পারে।‌ এর সমাধান সহজ নয়। অনেক ধৈর্য আর পরিশ্রমের প্রয়োজন। এই উচ্চারণকে একসেন্ট বলা হয়।সাধারণত ইংরেজি দুই ভাবে উচ্চারণ করা হয় - আমেরিকার একসেন্ট আর ব্রিটিশ একসেন্ট। দুটোর মধ্যে অনেক ব‍্যবধান। আমাদের জন্য দুটোই আপাতদৃষ্টিতে কঠিন কিন্তু আমেরিকান আর ব্রিটিশরা একে অন্যের উচ্চারণ অনায়াসে বুঝতে পারে। আমাদের এশিয়া উপমহাদেশে সাধারণত ব্রিটিশ একসেন্ট চলে।
ইংরেজি উচ্চারণ বুঝতে হলে টিভি দেখা সবচেয়ে ভালো। নিউজ চ্যানেল, সিনেমা আর ইংরেজি টিভি সিরিয়াল দেখা চালু করে দিলাম। এইচবিও, স্টার মুভিজ ইত‍্যাদি চ‍্যানেলে সিনেমা চলাকালীন টিভির পর্দায় ডায়লগ লিখে দেয়া থাকে। একে সাবটাইটেল বলা হয়। ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় এক একটি শব্দ অভিনেতারা কিভাবে উচ্চারণ করছেন। বুঝতে না পারলে সাবটাইটেলের সাথে মিলিয়ে নেয়া যায়। পরবর্তী এক মাস আমি টিভি দেখতে থাকতাম। আমার উদ্দেশ্য কাহিনী উপভোগ করা ছিল না। দৈনন্দিন উচ্চারিত শব্দগুলো কিভাবে বলা উচিত তা জানতে ঐসময়ে এর থেকে ভালো আর কোন মাধ্যম ছিল না। আগেই বলেছি তখন‌ও‌ ইন্টারনেট এক্সেস সহজলভ্য ছিল না।
ইন্টারভিউয়ে সাধারণত আসা কয়েকটি প্রশ্ন‌ জানা ছিল। উত্তর কাগজে লিখে দিন রাত আওড়াতে থাকতাম। মাত্র দুটো পৃষ্ঠা ছিল। কথোপকতনের জড়তা কাটানোর একটি ভালো উপায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার প্রেকটিস করা। আমিও করতে থাকতাম। একটা কেসেট রেকর্ডার কিনে আনলাম। রোজ অন্তত বিশ বার নিজের উচ্চারণ রেকর্ড করতাম আর শুনতাম। এর পর তুলনা করতাম টিভিতে শুনা শব্দের সাথে। এসব সেল্ফ প্রেকটিস কত বিরক্তিকর তা যে করে সেই জানতে পারবে। আমার বিরক্ত হলে চলবে না।
প্রায় মাসখানেক পর মুকেশ আঙ্কেলের অফিসে গেলাম। উদ্দেশ্য উনার কাছে একবার প্রেকটিস করা। উনি খুব ব‍্যস্ত থাকায় পরের দিন‌ যেতে বললেন। গেলাম। উনি আমার ইন্টার্ভিউয় নিলেন। কাগজে লেখা প্রশ্নের উত্তর উনি অনেকটা বদলে দিলেন। আমাকে পড়ে শুনালেন কিভাবে বলা দরকার। আরও প্রেকটিস করতে বললেন। কয়েকটি ইংরেজি বর্ণের উচ্চারণ ঠিক হচ্ছিল না।‌ উনি বারবার আমাকে শুনালেন যাতে চিরদিনের জন্য আমার মনে থেকে যায়।
কয়েকদিন পর আব্বা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। আমি একাই থাকতাম কোয়ার্টারে। খুব কম ঘর থেকে বের হতাম। খালি খাওয়ার সময় মেসে যেতাম। প্রেকটিস আর খবরের কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজে দেখা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না। এরমধ‍্যে একদিন আহমেদাবাদে দুটো কনসালটেন্সি কোম্পানিতে বায়োডাটা জমা করে এলাম। কিছু কোম্পানিতে আবার টাকাও দিতে হয়। আমি কিন্তু ফ্রী রিক্রুটমেন্ট কোম্পানিতেই বায়োডাটা দিলাম। পনেরো দিন পর আব্বা ফিরে এলেন। একদিন আসপাশের কোয়ার্টারের ছেলেরা পিকনিকের আয়োজন করল। খুব পিড়াপিড়ি করায় ওদের সাথে জামনগর ঘুরে এলাম।
পরের সপ্তায় একটি কল‌ এলো। ইফেকটিভ টেলিসারভিস থেকে। সেই যে এআইএম‌এসে সেমিনারে গিয়েছিলাম ওখানে ওদের স্টলেও বায়োডাটা জমা দিয়েছিলাম। প্রায় দুমাস পর আমাকে ওরা কল করল। পরের দিন ইন্টার্ভিউয়ে যেতে হবে। গুজরাটে এসে এটি আমার দ্বিতীয় অফিসিয়াল ইন্টার্ভিউ। হয়তো এই ইন্টার্ভিউ আমার জীবন বদলে দিতে চলছে।


প্রবাসের ডাক: ১১
গান্ধী নগরের ঠিক বাইরে জমে উঠেছে ইনফরমেশন টেকনোলজির প্রাণকেন্দ্র ইনফোসিটি। গুজরাটের বৃহত্তম আইটি হাব এই ইনফোসিটি সিলিকন ভ্যালির সাথে টক্কর দিতে সক্ষম। প্রবাসি ভারতীয় ব‍্যবসায়ি শ্রী দিলিপ বারোট আর গুজরাট সরকারের যৌথ উদ্যোগে ইনফোসিটি বানানো হয়েছে। চোখ ধাঁধানো সুন্দর ৭/৮ টা অফিস টাওয়ার, ক্লাব হাউস, সপিং সেন্টার, আবাসিক ফ্ল‍্যাট ইত‍্যাদি অত‍্যাধুনিক সুবিধা দিয়ে সাজানো ইনফোসিটি দেখলে বোঝা যায় ভারত এখন ইউরোপ আমেরিকা সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রস্তুত। আমাকে এই ইনফোসিটিতেই ইন্টার্ভিউ দিতে যেতে হবে। স্নেহল নামের মেয়েটি আমাকে ফোন করে এড্রেস দিয়েছিল - আইটি টাওয়ার ওয়ান, অফিস নম্বর ৩০৩। ১১ টায় পৌঁছতে হবে।
আব্বা আমাকে একটি অটোরিক্সা ভাড়া করে পাঠিয়ে দিলেন। রিক্সা মেইন গেটে নামিয়ে দিল। গেটের লাগোয়া সিকিউরিটি অফিসে নাম ঠিকানা লিখে দিয়ে চলে গেলাম এক নম্বর টাওয়ারে। অনেক জায়গা নিয়ে বিস্তৃত ছয় তলা বিশিষ্ট নিল রংয়ের টাওয়ারের তিন তলায় যেতে হবে আমাকে। লবি থেকে লিফ্ট নিয়ে পৌঁছে গেলাম। লিফ্ট থেকে বেরিয়েই রিসেপশন। টি-শার্ট আর জিন্স পরা কম বয়সী একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন। উনিই আমাকে ফোন করেছিলেন। আমার বায়োডাটা জমা নিয়ে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খেতে দিলেন। জানতে পারলাম আমার ইন্টার্ভিউ নেবেন একাউন্ট মেনেজার প্রকাশ পেটেল (নাম পরিবর্তিত)। আমি সোফায় বসে আমার ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ইফেকটিভ টেলিসারভিসের অফিস খুব সুন্দর তা রিসেপশন থেকেই বোঝা যায়। যে চেয়ারে স্নেহল বসে আছে ওর পেছনের দেয়ালে রুপালি রঙের স্টিল দিয়ে কোম্পানির মনোগ্রাম বড় বড় হরফে খোদাই করা। রিসেপশনের দুইদিকে দুটো গেইট। বাইরে থেকে দেখছিলাম দুই তিন মিনিট পর পর গেট খুলে কর্মচারীরা বাইরে আসছিলেন আর লিফ্টে চড়ে বাইরে যাচ্ছিলেন। অনেকেই আবার কফির কাপ হাতে নিয়ে কিংবা একাধিক কর্মি গল্প করতে করতে বাইরে থেকে এসে ভিতরে চলে যাচ্ছিলেন। অফিসের আঁকার দেখে অনুমান করলাম এখানে কমসে কম শতাধিক লোক চাকরি করেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ডাক এলো। স্নেহল আমাকে ভিতরে নিয়ে একটি কক্ষে বসাল। মিঃ পেটেল এখানে এসে আমার ইন্টার্ভিউ নেবেন। ছোট রুমটির মাঝখানে একটি বড় কাঁচের টেবিল। টেবিলের চারিদিকে মোট ছয়টি চেয়ার। এসি চলতে থাকায় ভেতরটা খুব ঠাণ্ডা ছিল। কাঁচের দেয়ালের ওপাশে এক‌ই অবয়বের আরেকটি টাওয়ার দেখা যাচ্ছিল। উঁকি মেরে দেখলাম দুটো টাওয়ারের মাঝখানে সবুজ ঘাস ঢাকা লন। আমাকে আরো প্রায় পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হলো। যত সময় অপেক্ষা করছিলাম তত‌ই নার্ভাস হচ্ছিলাম। বার বার আমার রেডিমেড উত্তর গুলো আওড়ে নিচ্ছিলাম। এবার যাতে ভূল না হয়।
একসময় মিঃ পেটেল দরজায় নক করে রুমে এলেন। বছর পঁয়ত্রিশের অত‍্যন্ত ফর্সা ভদ্রলোক স‍্যুট টাই পরে আছেন। আমাকে বসতে বলে উনার কোটের পকেট থেকে জ‍্যামিতির বাক্সের আঁকারের মোবাইল ফোন বের করে আনলেন আর ব‍্যস্ত হয়ে পড়লেন। সম্ভবত মোবাইলে কোন ইমেল পড়েছিলেন। উনার কপালের ভাজ আর মুখের চাহনির থেকে মেজাজ কেমন আছে এটা বের করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু বোঝতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি ফোন বন্ধ করে পেন্টের পকেটে রেখে দিলেন আর আমাকে এতক্ষন বসিয়ে রাখার জন্য দূঃখ প্রকাশ করলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে আমার নাম আর কোথা থেকে এসেছি জিজ্ঞেস করলেন। এরপর আমার বায়োডাটা নিয়ে পড়তে লাগলেন। আমার সাফ মনে আছে। উনি আমাকে মাত্র দুটো প্রশ্ন করেছিলেন। অবশ্যই ইংরেজিতে। প্রথম - আমি কোন ইনডোর খেলা ভালোবাসি। আমি বললাম - দাবা। এর পর জিজ্ঞেস করলেন - কোন গুটির চাল আমার পছন্দ। বললাম ঘোড়া। এইটুকুতেই ইন্টার্ভিউ শেষ। প্রশ্নের উত্তরের দুটো বাক‍্যে প্রায় পনেরো বিশটি শব্দ‌ই ছিল। চোখের দিকে তাকিয়ে সোজা বললেন আমার ইংরেজি ভালো নয়। তাই চাকরি পাওয়া অসম্ভব। ইফেকটিভ টেলিসারভিসের সব ক্লায়েন্ট আমেরিকান। ওরা আমার কথা বোঝতে পারবে না। উনি অত‍্যন্ত নম্রতার সাথে আমাকে কথাগুলো বুঝিয়ে বলছিলেন। এরপর আমাকে বসতে বলে উনি চলে গেলেন। আমি নিরাশ হয়ে উনার চলে যাওয়া দেখছিলাম। মাত্র দুই মিনিটেই ইন্টার্ভিউ খতম। আফসোস হচ্ছিল উনি আমাকে 'টেল মি এবাউট ইয়রসেলফ" জিজ্ঞেস করলেন না। এই প্রশ্ন করলে আমি ভালো করে বলতে পারতাম। এতোদিনতো এটাই প্রেকটিস করছিলাম।


প্রবাসের ডাক: ১২
মিঃ পেটেল চলে যাওয়ার পর আমি বসে রইলাম। বুঝতে পারলাম না আমাকে যেতে হবে না অন্য কোন ফর্মালিটির জন্য কারুর সাথে দেখা করতে হবে। কিছুক্ষণ পর উনি স্নেহল কে নিয়ে ঘুরে এলেন। আমি দাঁড়িয়েছিলাম। বসতে বললেন। মিঃ পেটেল বললেন যদিও আমার ইংরেজি কথোপকথন ততটা শুদ্ধ নয় তবুও আমার আত্মবিশ্বাস আছে। আমার ব‍্যাকরণে কোন ভুল ছিল না। তাই একটা সুযোগ দেয়া হতে পারে। তবে চাকরির নয়, ট্রেনিংয়ের। ট্রেনিংয়ে যদি আমি ভালো করে কথোপকথন আয়ত্ত করতে পারি তবে চাকরি হয়ে যাবে। আমার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। সত্যিই এমন হতে পারে! অজান্তেই চোখের কোনায় জল এসে গিয়েছিল। নিজেকে সামলে নিলাম।
মিঃ পেটেল চলে গেলেন আর স্নেহল আমাকে 'ভয়েস এন্ড একসেন্ট' ট্রেইনার মিঃ নায়ার ‌(নাম পরিবর্তিত) এর কাছে নিয়ে এলো। উনিও আমার ইন্টার্ভিউ নেবেন। উনার যদি মনে হয় আমি ট্রেনিংয়ের যোগ‍্য তবে সুযোগ দেয়া হবে। ভদ্রলোক কম্পিউটারে কাজ করছিলেন। আমাদেরকে দেখে বসতে বললেন। এরপর আমাকে সেই সোনালী প্রশ্নটি করেই ফেললেন। টেল মি এবাউট ইয়রসেলফ! ব‍্যাস, আমি গড়গড় করে বলে ফেললাম। উনার অভিব‍্যক্তি দেখে মনে হলো কাজটা হয়ে গেছে। উনার খারাপ লাগেনি। একটি ফর্ম পূরণ করতে দিলেন। দুদিন পর ট্রেনিং চালু হবে। ঠিক নয়টায় ক্লাস চালু হবে আর চলবে চারটে অবধি। একমিনিট দেরি হলে চলবে না। মাঝখানে দুপুরের খাবারের জন্য আধা ঘন্টা সময় দেয়া হবে। গ্রাউন্ড ফ্লোরের কেফেটিরিয়ায় বিনামূল্যে খাবার পাওয়া যাবে তবে এর জন্য রিসেপশন থেকে ফুড কুপন সংগ্রহ করতে হবে। আমাকে ট্রেনিংয়ের জন্য কোন পয়সা দিতে হবে না। ইফেকটিভ টেলিসারভিস আর গুজরাট সরকার যৌথভাবে এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে। বিশ দিন প্রশিক্ষণের পর পরীক্ষা নেয়া হবে। পাশ করতে পারলে সার্টিফিকেট দেয়া হবে আর কোম্পানিতে ভয়েস এজেন্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেয়া হবে। ট্রেনিংয়ের জন্য ২৫০০ টাকা স্টাইপেন্ড‌ও দেয়া হবে। কমসে কম চল্লিশ জন ব‍্যক্তি প্রশিক্ষণে অংশ নেবেন। যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে তাদেরকে এপোয়েন্টমেন্ট লেটার দেয়া হবে। মিঃ নায়ার আরও বললেন যদি চাকরি পাই তবে শুরুতে ৭৫০০ টাকা বেতন থাকবে। এর উপরে যথেষ্ট ইনসেনটিভ (বোনাস) কামানোর সুযোগ থাকবে। তবে এরজন্য মনোযোগ দিয়ে সবকিছু শিখে নিতে হবে। পাঠ‍্যক্রমের মধ্যে থাকবে - গ্রামার, স্পোকেন ইংলিশ, এক্সেন্ট নিউট্রেলাইজেসন, আমেরিকান এক্সেন্ট, বিজনেস ইংলিশ, টেলিফোন এটিকেটস্, কম‍্যুনিকেশন স্কিলস ইত‍্যাদি। মিঃ নায়ার যাওয়ার আগে বলে দিলেন অফিসে আসার রাস্তা চিনে নিতে আর জাতায়াতের জন্য ব‍্যবস্তা আগে থেকেই ঠিক করে নিতে। কারণ দেরি হলে ক্লাসরুম থেকে বের করে দেয়া হবে।
খুব খুশি হয়ে কেম্পে ফিরলাম। আসার আগে মিঃ পেটেল আর স্নেহলকে বারবার ধন্যবাদ জানালাম। জানতাম এটাতো কেবল ট্রেইনিং কিন্তু আমার মন বলছিল আমি পাশ করব। সবচেয়ে খুশি ছিলেন আব্বা। বাড়িতে ফোন করে আম্মা আর ছোট ভাইকে জানিয়ে দিলাম। খুব হালকা লাগছিল। এতদিন একটা মানসিক চাপ ছিল। আজ আর নেই। এখন আমার একটাই উদ্দেশ্য। খুব মন লাগিয়ে ট্রেনিংয়ে থাকতে হবে আর যা শেখানো হবে তা আয়ত্ত করতে হবে। মনে হচ্ছিল আমি চাকরিটা পেয়ে যাব কিন্তু তখন অনুমান‌ও করতে পারিনি আগামী সপ্তাহগুলো কি ভয়ঙ্কর হতে চলছে।


প্রবাসের ডাক: ১৩
ট্রেনিং আরম্ভ হলো সোমবার। রোজ নয়টা থেকে শুরু হয়ে চলবে বিকেল চারটা পর্যন্ত। রবিবার ছুটি। আমাদের ক্লাস হবে ১ নম্বর কনফারেন্স হলে। প্রথমদিন যখন ক্লাসে পৌঁছি তখনও নয়টা বাজে নি। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ প্রার্থী এসে গেছেন। আমি চার বা পাঁচ নম্বরের সারিতে একটি চেয়ার খালি দেখে বসে পড়লাম। এক একটি চেয়ারের সাথে সংলগ্ন ছোট্ট টেবিল যাতে নোট নেয়া যায়। আমি আসার পর আরও দুই তিন জন প্রশিক্ষণার্থী এলেন। ক্লাসরুম ভর্তি হয়ে গেল। মিঃ নায়ার যখন কোঠায় প্রবেশ করেন তখন নয়টা বেজে গেছে।
মিঃ নায়ার গুড মর্নিং বলে আধা বোতল জল খেয়ে নিলেন। শুরু হলো রোল-কল। সবাই উপস্থিত। এরপর উনি ডানদিকের সারি থেকে একে একে সবাইকে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিতে বললেন। বলতে হবে নাম, ঠিকানা, পরিবারের বিষয়, পড়াশোনা, কাজের অভিজ্ঞতা, পছন্দ অপছন্দ ইত‍্যাদি। এই সেসনটা খুব আকর্ষণীয় ছিল। সবাই একে অপরের ব‍্যাপারে জানতে আগ্রহী বোঝা যাচ্ছিল। কয়েকজন সহকর্মী যাদের চেহারা ও বক্তব্য এখনও মনে আছে তারা হলেন রিজু জর্জ, তেজেন্দ্র সিং, রনজিত সিং চৌহান, নিষাদ কৃষ্ণন, কুলদীপ সম্পথ, গৌরাঙ্গ চাওড়া, কুনাল খ্রীষ্টদেব, ভুমি পেটেল, অনিন্দিতা চৌধুরী, জনী ডাডলানি, বিজয় পারমার, অজিত দাস। এদের নাম উল্লেখ করার কারণ আছে। আগত দিনগুলোয় এমনকি এখন‌ও এদের উপস্থিতি আমার সাদামাটা জীবনকে গাল্পিক রসে টইটুম্বুর করে রেখেছে। অনেকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আর এখন‌ও সবার সাথে যোগাযোগ আছে। আগামী পর্বগুলোয় এদের বিষয়ে অনেক কিছু লেখব বলে ভাবছি।
সবাই পরিচয়পর্ব শেষ করলেন। আমাদের ব‍্যাচের অনেকেই সদ‍্য স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। মাত্র কয়েকজনের কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। বাকি সবাই ফ্রেশার্স। মনে হলো সেই কলেজের ক্লাসে এসে গেছি। কিন্তু সেই সময় আর আজকের দিনে অনেক ফারাক। তখনকার হৈ হুল্লোড়ের জায়গায় আজ ভাব গম্ভীর পরিবেশ। ফুর্তির স্থান নিয়ে গেছে কর্পোরেট জগতের ইঁদুর দৌড়।
মিঃ নায়ার আমাদের কোর্স কারিকুলাম বুঝিয়ে দিলেন। আমাদেরকে ইংরেজির উচ্চারণ শুদ্ধ করতে হবে। মুলত কোম্পানির ক্লায়েন্ট সব আমেরিকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্লায়েন্ট এটি এন্ড টি (আমেরিকান টেলিফোন এন্ড টেলিগ্রাফ কোম্পানি) র জন্য আমাদেরকে কাজ করতে হবে। আমাদেরকে ভয়েস এজেন্ট হিসেবে গ্রাহকদের টেলিফোন রিসিভ করতে হবে। মুলত কল আসবে কাস্টমার কেয়ার বিষয়ে বা কোম্পানির প্রডাক্ট সম্পর্কে। এটি এন্ড টি আমেরিকার টেলিফোন, মোবাইল এবং ইন্টারনেট পরিষেবায় অদ্বিতীয় নাম। কোম্পানি ইফেকটিভ টেলিসারভিসকে দক্ষিণ আমেরিকার রাজ‍্যগুলোর কাস্টমার কেয়ার সেন্টার আর সেইলস সেন্টার আউটসোর্স করেছে। যে রাজ‍্যের গ্রাহকরা আমাদেরকে কল করবেন সেই রাজ‍্যগুলো হলো - ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, সাউথ কেরোলিনা, নর্থ কেরোলিনা, এলাবামা, কেন্টাকি, মিসিসিপি, লুইজিয়ানা আর টেনেসি। ওখানকার লোক যে ভাবে ইংরেজি উচ্চারণ করেন তা আমেরিকার অন‍্যান‍্য রাজ‍্যগুলোর থেকে আলাদা। মিঃ নায়ার বললেন আমাদেরকে ওদের কথোপকথনের রেকর্ডিং শুনানো হবে। সচরাচর যে সমস্ত বাক‍্য বা শব্দ ব‍্যবহৃত হয় তার উচ্চারণ বারবার অনুশীলন করতে হবে। একশ শতাংশ মনোযোগ আর পরিশ্রম করার মানসিকতা না থাকলে আমরা চলে যেতে পারি কিন্তু সত্যিই যদি চাকরির দরকার হয় তবে এ এক সোনালী সুযোগ। আগামী বিশ দিন আমাদেরকে যে কোর্সটা করানো হবে তা বাইরে থেকে করলে অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবে। তাই এই সুযোগ হারানো উচিত নয়। আমি সহমত ছিলাম। ভদ্রলোক ঠিকই বলছিলেন।
উনি আরও বললেন আমাদেরকে রোজ হোম‌ওয়ার্ক দেয়া হবে। যদি দৈনিক হোম‌ওয়ার্ক অসম্পূর্ণ থাকে তবে চলবে না। ঐদিন‌ই আমাদেরকে ট্রেনিং থেকে বের করে দেয়া হবে। উনি জানালেন আমাদের পুর্ববর্তি ব‍্যাচের চল্লিশ জনের মধ্যে থেকে মাত্র নয়জন পাশ করেছেন। বাকি সবাই হয়ত চলে গেছেন নয়তো বহিস্কার করা হয়েছে। মিঃ নায়ার আমাদেরকে প্রথম দিন ইংরেজি অক্ষর K এবং C এর উচ্চারণ শেখালেন। বুঝতে পারলাম এতদিন যেভাবে উচ্চারণ করে আসছি আমেরিকার লোক ওভাবে উচ্চারণ করে না। সাধারণত এই দুটো অক্ষরকে চাপ দিয়ে উচ্চারণ করতে হয়। ইংরেজি শব্দ cat কে কিছুটা "ক্ষেট" এর মতো বলতে হয়।‌ এই উচ্চারণ লিখে বোঝানো কঠিন। কারুর যদি এই অক্ষরের উচ্চারণ জানতে ইচ্ছে হয় তবে ইউটিউবে ভিডিও দেখে নেবেন। মিঃ নায়ার এক একটি ক অক্ষরের শব্দ বলে যাচ্ছিলেন আর আমরা পাঠশালার ছাত্র ছাত্রীদের মতো একসাথে উচ্চস্বরে কোরাস উচ্চারণ করে যাচ্ছিলাম। উনি খুব মন দিয়ে সবাই কিভাবে বলছে লক্ষ্য করছিলেন আর ভুল হলে শুদ্ধ করে দিচ্ছিলেন। অকস্মাৎ পেছনের সারিতে হাঁসির আওয়াজ শুনা গেল।‌ উনি ফার্স্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং দেয়ায় কনফারেন্স হলে আলপিন পতন নিরবতা ফিরে এলো।
এর পর মধ‍্যান্হভোজনের বিরতি হলো। আমরা সবাই রিসেপশন থেকে ফুড কুপন সংগ্রহ করে কেফেটিরিয়ায় চলে গেলাম। সেল্ফ সার্ভিস রেস্তোরাঁ। লম্বা টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নিজের হাতে প্লেইট উঠিয়ে যা খাওয়ার ইচ্ছা তা নিয়ে নিতে হবে আর হলে পেতে রাখা চেয়ার টেবিলে বসে খেতে হবে। সুস্বাদু নিরামিষ খাবার। ভাত, রুটি, দুটো তরকারি, ডাল, দ‌ই আর স‍্যালাড। খাবারের টেবিলে রঞ্জিত আর বিজয় বসেছিল। ওদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আলাপ হলো। রঞ্জিত গান্ধী নগর সেক্টর তিরিশ এ থাকে আর বিজয় পারমারের বাড়ি আহমেদাবাদের সরদার নগর এলাকায়। ভাত খেয়ে আমরা তিনজন টাওয়ারের সামনের বাগানে বসলাম। ক্লাসের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হ‌ওয়ার এখনও দশ মিনিট বাকি ছিল। আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল। বাগানের বেঞ্চিতে বসে খুব ভালো লাগছিল। চারদিকে কি সবুজ ঘাসের গালিচা! বড় বড় গাছ। এই গরমেও কি সুন্দর হাওয়া চলছিল। অত‍্যন্ত আধুনিক হ‌ওয়ার সাথে সাথে গোটা ইনফোসিটি এলাকা প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। এখনকার সময় হলে হয়তো ফট ফট করে সেল্ফি তোলা চালু হয়ে যেত। কিন্তু তখনো‌ও ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা স্মার্টফোন আমাদের জীবনে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি।


প্রবাসের ডাক: ১৪
ট্রেনিংয়ের প্রথম দিন গল্পগুজবেই কেটে গেল। মিঃ নায়ারকে যতটুকু সিরিয়াস ভেবেছিলাম ততটুকু নন। ভদ্রলোক আমুদে কিন্তু আমাকে সাবধান থাকতে হবে। ভুল করলে পোষাবে না। ক্লাস শেষ হ‌ওয়ার আগে আমাদেরকে হোম‌ওয়ার্ক দিলেন। সবাইকে তিনটে করে A4 সাইজের কাগজ প্রিন্ট করে দিলেন।‌ এতে চারটে ছোট ছোট অনুচ্ছেদ ছাপানো আছে। বেশিরভাগ শব্দ‌ ইংরেজি C আর K অক্ষরের দিয়ে। বাক‍্যের যেখানেই 'ক' অক্ষরের শব্দ থাকুক না কেন আমাদেরকে এর সঠিক উচ্চারণ মনে রাখতে হবে। মিঃ নায়ার পৃষ্ঠা তিনটে দু'বার করে পড়ে শোনালেন। এরপর সামনের সারিতে বসে থাকা বিজয় পারমারকে পড়তে দিলেন। ও বার বার ভুল করে যাচ্ছিল আর মিঃ নায়ার সামান্য‌ও মর্মাহত না হয়ে ধৈর্য্যের সাথে ওকে কারেক্ট করে দিচ্ছিলেন। পেছন থেকে হালকা হাঁসির আওয়াজ আসায় একবার মিঃ নায়ার ক্ষেপে গেলেন। পরমুহূর্তেই নিজেকে সংযত করে উনার নিল রংয়ের বোতল থেকে জল খেয়ে বললেন আরেকবার হাঁসি বরদাস্ত করা হবে না।‌কনফারেন্স হলে কেমেরা লাগানো আছে। প্রয়োজনে রেকর্ডিং দেখে যিনি হাসছিলেন উনাকে বিদায় দিতে সময় লাগবে না। আমি জানতাম ‌আওয়াজটা কার। নির্ঘাত শ্রীযুক্ত রনজিত সিং চৌহান‌ই বিজয় পারমারের অদ্ভুত উচ্চারণ শুনে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেন নি।
মিঃ নায়ার আরও বললেন আমাদেরকে মুখ প্রসারিত করে উচ্চস্বরে পড়তে আর বলতে হবে। মিনমিনিয়ে কথা বললে চলবে না। বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে চোখ রেখে চর্চা করে যেতে হবে। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। ঐ আর্টিকেলগুলো ছাড়া আরও হোম‌ওয়ার্ক ছিল। আমাদেরকে রাতে যে কোন একটি ইংরেজি সিনেমা আর আর ইংরেজি সংবাদ দেখে এর সারমর্ম নিজের ভাষায় লিখে এনে সবার সামনে পড়ে শুনাতে হবে। সিনেমার সারমর্ম দুই পৃষ্ঠার মধ্যে হতে হবে আর ইংরেজি সংবাদের সারমর্ম এক পৃষ্টায় চাই। এর পর ছুটি হয়ে গেল। সবাই এমন ভাবে দৌড়ে বের হলেন যেন কোনো কলেজের ক্লাস শেষ হলো। রনজিত সিং আমাকে ওর বাইকে বসিয়ে কেম্পে ছেড়ে আসবে বলল। আমি ওকে কস্ট না দিয়ে ইনফোসিটির সামনে থেকে অটোরিক্সা নিয়ে নিলাম। পথিকাশ্রমে নেমে ওখান থেকে বাসে চড়লাম। কেম্পে যখন পৌঁছি তখন দুরের কোন এক মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি কানে আসছিল।
আজ আব্বার সাথে খুব গল্প হলো। বারবার উনাকে ইফেকটিভ টেলিসারভিস আর ট্রেনিংয়ের কথা বলছিলাম। মিঃ নায়ার কি শেখালেন তাও শুনালাম। আমার কথা যেন শেষ হচ্ছিল না। রাতের ভাত খেয়ে টিভি চালু করলাম। সাড়ে নয়টার সময় এইচবিও চেনেলে শুরু হলো এংগার মেনেজমেন্ট নামের একটি কমেডি সিনেমা। আমি নোট নেয়া শুরু করে দিলাম। প্রায় রাত বারোটায় লেখা শেষ করে শুতে গেলাম। সকালে নিউজ দেখে আরেকটি অনুচ্ছেদ লিখতে হবে। রিডিং প্রেকটিস তো আর হল‌ই না। ভাবলাম আগামীকাল পেছনের সারিতে বসব। আমার আগে যারা বসবে তাদের পড়া শুনে আমার‌ও‌ প্রেকটিস হয়ে যাবে।
পরের দিন খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গলো। সাতটার সময় টাইমস না‌ও চ‍্যানেলের নিউজ শুনে কোনমতে এক পৃষ্টা লিখে নিলাম। আরও একঘন্টা পড়ার প্রেকটিস করলাম। কেম্পের সামনে থেকে বাসে পথিকাশ্রম আর ওখান থেকে অটোরিক্সায় ইনফোসিটি পৌঁছে গেলাম। তখন‌ও দশটা বাজেনি। এরমধ্যে অনেক প্রার্থী এসে গেছেন। ইনফোসিটির গেটের বাইরে গাছের নিচে একটি চায়ের দোকান। আমরা সবাই ওখানে চলে গেলাম। খাঁটি গরুর দুধে চা পাতা ফুটিয়ে বানানো কি সুস্বাদু চা। আমাদের আসামে না আছে দুধ আর না আছে এমন চা।
আমাদের ব‍্যাচে মাত্র তিনজন মহিলা ছিলেন। এরমধ্যে একটি মেয়ে বাঙ্গালি। নাম নন্দিতা চৌধুরী। বাবা আহমেদাবাদে অএনজিসির বড়বাবু। আসল বাড়ি ত্রিপুরার আগরতলা শহরে। খোলামেলা মনের নন্দিতার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম শখ করেই ও চাকরি করতে এসেছে। বাড়িতে টাকার অভাব নেই। এখানে চাকরি করা মানে অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে আর হাত খরচাও চলে যাবে। ওর মুখেই জানতে পারলাম আমাদের ব‍্যাচে আরেকটি বাঙ্গালী ছেলে আছে। অজিত দাস। ওর সঙ্গেও পরিচয় হয়ে গেল। ওর বাবা সদ‍্য অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মি। ওর আসল বাড়ি আজ‌ও‌ জানিনা। পরবর্তীতে ওর সাথে ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বার বার জিজ্ঞেস করার পর‌ও কখনও ও নিজের আসল বাড়ির কথা বলে নি। ও কিন্তু করিমগঞ্জ হা‌ইলাকান্দি শিলচরের অলিগলি খুব ভালো করে চেনে। আমার মনে হয় ওর আসল বাড়ি হাইলাকান্দিতেই হবে।


প্রবাসের ডাক: ১৫
দুদিন ট্রেনিংয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমি ক্লাসে শেখানো সবকিছু ঠিকঠাক আয়ত্ত করতে পারছিনা। প্রথম দুদিন যে হোম‌ওয়ার্ক করে নিয়েছিলাম তাও ভালো হয়নি তাই সবার সন্মুখে বকুনি খেতে হয়েছে। মিঃ নায়ার খুব মন দিয়ে বারবার আমাকে শুনিয়ে দিচ্ছিলেন কিভাবে প্রতিটি ধ্বনি উচ্চারিত হয়। বারবার চেষ্টা করেও আমি উনার মত উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। ক্রমে হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম। এমন ভাবছিলাম যে আমার দ্বারা হবে না। এভাবে চলতে থাকলে একদিন ট্রেনিং থেকে বের করে দেয়া হবে। কিন্তু পরিশ্রম করে যাচ্ছিলাম।
এর মধ্যে আমরা ইংরেজি অক্ষর P, T, Z আর স্বরবর্ন A, E, I, O, U. W, Y এর স্থানভেদে উচ্চারণের বহুমুখীতা শিখে নিয়েছি। এই ট্রেনিংয়ে এসে জানতে পারলাম কেন আমাদের উচ্চারণ হাস‍্যকর হয়। আমাদের স্কুল কলেজে ইংরেজি চর্চার তো কোন সুযোগ নেই। ভুল উচ্চারণ শুদ্ধ করে দেবেই বা কে। এখানে খালি নিউট্রেল উচ্চারণ নয় বরং আমেরিকার ইংরেজি উচ্চারণ শেখানো হচ্ছিল। তাই আমরা ব‍্যাচের সবাই সহজে শিখতে পারছিলাম না। এরমধ্যে আমার পারফরম্যান্স সবচেয়ে খারাপ ছিল। মাতৃভাষার টিপিক্যাল খোলস থেকে বেরিয়ে অন‍্য দেশের উচ্চারণ আর ধ্বনি আয়ত্ত করা খুব কঠিন লাগছিল।
এর মধ্যে ট্রেনিংয়ের এক সপ্তাহ হয়ে গেল। উইকেন্ডে একবার পরীক্ষা নেয়া হলো। ১০০ নম্বরের পরীক্ষা। দুটো অনুচ্ছেদ লিখে দিতে হবে যার জন্য মোট নম্বর থাকবে চল্লিশ। বিশ নম্বরের তাৎক্ষণিক বক্তৃতা থাকবে। মিঃ নায়ার বক্তৃতার বিষয় ঠিক করে দেবেন।‌ আর চল্লিশ নম্বরের থাকবে রিডিং টেস্ট। এর মধ্যে অনুচ্ছেদ আর কিছু বিশেষ শব্দ আর বাক‍্য থাকবে।
আগের দুদিন আমাদেরকে "ইনটোনেশন" শেখানো হয়ে গেছে। ইনটোনেশন মানে কথা বলার সময় শ্রুতিমাধুর্য্যের জন্য বাক‍্যকে প্রয়োজনে কখনও হালকা সুর ও ছন্দময় করে বলা, কখনও দুটো শব্দ একে অন্যের সাথে মিলিয়ে দেয়া ইত্যাদি। এবিষয়ে অধিক আগ্রহী হলে ইউটিউবে ভিডিও দেখতে পারেন। সঠিক ইনটোনেশন আমাদের কথ‍্য ইংরেজিকে অত‍্যন্ত শ্রুতি মধুর করে তোলে আর ভুল হলে হাস‍্যকর হয়ে যায়। মিঃ নায়ার আমাদেরকে কিভাবে কথা বলার সময় আবেগ মিশিয়ে বলতে হয় তাও শেখালেন। যেমন কাউকে একেবারে সাদা মাটা ভাবে থ‍্যাঙ্ক ইউ বলা যায় কিন্তু সঠিক ইনটোনেশন আর আবেগ মিশিয়ে থ‍্যাঙ্ক ইউ বললে শ্রুতার মনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মাতৃভাষায় এই ইনটোনেশন আমরা অহরহ ব‍্যবহার করি।
পরীক্ষায় আমার অনুচ্ছেদ লেখন ভালোই হয়েছিল কিন্তু কয়েকটি বাক‍্য আর শব্দের উচ্চারণ ঠিক মতো করতে পারলাম না। ইনটোনেশন আর ইমোশনের বেলায়‌ও জিরো। মাত্র কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থী পঞ্চাশের উর্ধ্বে নম্বর পেয়েছেন। আমি পেলাম ৪৭।‌ চার পাঁচ জন তো আবার তিরিশের‌ও কম নম্বর পেয়েছেন। সর্বোচ্চ নম্বর পেল ভুমি নামের মেয়েটি।‌ ও পেয়েছে ৭৬। মিঃ নায়ার আমাদেরকে বলে দিলেন পরবর্তী সাপ্তাহিক পরীক্ষায় যাদের নম্বর চল্লিশের কম থাকবে তাদেরকে বের করে দেয়া হবে।
পরের সপ্তাহের ক্লাস শুরু হলো। মিঃ নায়ার একদিন আমাকে বলেই ফেললেন যে নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার ছেলে মেয়েদেরকে শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানো প্রায় অসম্ভব। এরা মাদার টাং ইনফ্লুয়েন্স‌ কোনভাবেই ছাড়তে পারে না। তাই আমি নাকি অযথা সময় নস্ট করছি। উনি বললেন যদি আমি এই ক্লাসে শিখতে পারি না তবে এই ইন্ডাস্ট্রিই ছেড়ে দেয়া উচিত। অন‍্য কোথাও দশটা পাঁচটার চাকরি খুঁজা উচিত। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তবুও ভেঙ্গে পড়লাম না। মুলত আমার অসুবিধা হচ্ছিল V, W, T ইত‍্যাদি শব্দের উচ্চারণে। ইনটোনেশন‌ও সঠিক ভাবে ব‍্যবহার করতে পারছিলাম না। যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করছিলাম। কিন্তু মিঃ নায়ারের মতো হচ্ছিল না। খালি আমার নয়, ব‍্যাচের দুই তিন জন কে ছেড়ে সবাই ভুল করছিলেন মিঃ নায়ারের ধৈর্য্য আর পরিশ্রম ছিল দেখার মতো। উনি খুব পরিশ্রম করে সবাইকে বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
ট্রেনিংয়ের দশ এগারো দিন পর আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হলো। কারণটা কিন্তু পারফরম্যান্স নয়। মনে নেই কেন আমার হঠাৎ করে হাঁসি এসে গিয়েছিল। মিঃ নায়ার রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আমাকে দাঁড়াতে বললেন। শুরু হলো উচ্চস্বরে উনার বকুনি। বললেন এক তো ভালো করে প্রেকটিস করছ না তার উপর ফাজলামো। এক্ষুনি আমার ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও। আর কখনও এই কোম্পানিতে তোমার মুখ দেখাতে আসবে না। আমার যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। দুঃখ আর ভয়ে এমন লাগছিল যে আমি পড়ে যাব। উনি আবার বললেন "গেট আউট ফ্রম মাই ক্লাস রাইট নাও"। আর কিচ্ছু করার নেই। খাতা কলম উঠিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বেরিয়ে এলাম। বাইরে রিসেপশন এসে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লাম। শেষ হয়ে গেল এক সুবর্ন সুযোগ।


প্রবাসের ডাক: ১৬
হঠাৎ করে ক্লাস থেকে বাইরে এসে সোফায় বসে পড়ায় স্নেহল চমকে উঠল। ট্রেনিং থেকে বের করে দেয়া হয়েছে জেনে ও অবাক। আমাকে জল খেতে দিয়ে বসতে বলল। ও নাকি মিঃ নায়ারের সঙ্গে কথা বলে দেখবে। হয়ত রাগের মাথায় উনি বেরিয়ে যেতে বলেছেন। উনাকে বুঝিয়ে বললে আরেকটি সুযোগ দিতেই পারেন। তবে মধ‍্যান্হভোজনের বিরতি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমি রিসেপশনে বসে রইলাম। মনে মনে স্রস্টার কাছে প্রার্থনা করছিলাম যাতে আরেক সুযোগ পাই। না হলে এত বড় কোম্পানিতে আর কোথায় চাকরি পাব।
দশ‌ মিনিট পর মিঃ নায়ার বেরিয়ে এলেন।‌ আমাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেন এখন‌ও বসে আছি। স্নেহল দৌড়ে এসে মিঃ নায়ারকে বলল ওই আমাকে বসিয়ে রেখেছে। আমাকে রেখে ওরা দুজন ভেতরের কনফারেন্স রুমে চলে গেলেন।
শীঘ্রই মিঃ নায়ার বেরিয়ে এসে আমাকে বললেন ক্লাস যেতে। যা হ‌ওয়ার হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে যেন এমন আর না হয়। আবার গিয়ে বসলাম ক্লাসে। খুব মন দিয়ে নোট নিলাম। ক্লাস শেষে রনজিত আমাকে ওর বাইকে করে কেম্পে ছেড়ে এল। আজকের ঘটনা আব্বাকে বললাম না। ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ হচ্ছিল। নিশ্চয়ই উনার মেহেরবানীতে এই যাত্রা বেঁচে গেলাম।
রবিবার কেম্পে ফুটবল ম্যাচ ছিল। ইন্টার বেটেলিয়ান গ্রুপ সিরিজের ফাইনাল। খেলা হবে দিল্লির ৭৩ বেটেলিয়ান আর চেন্নাইয়ের ১১৭ বেটেলিয়ানের মধ্যে। পুরো কেম্প ফেস্টুন, ফ্লেগ আর জায়গায় জায়গায় ওয়েলকাম তোরণ সাজানো হয়েছিল। বড় বড় অফিসার, কমান্ডার, ডিআইজি রেঙ্কের কর্মকর্তারাও খেলা দেখতে আসবেন। তাই কেম্পের চারিদিকে সাজ সাজ রব।
আবাসিক এলাকায় যারা থাকেন তাদের বেশির ভাগেরই সাপোর্ট দিল্লির টিমের প্রতি। আব্বার সহকর্মী অনিল আঙ্কেল আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। হাজার খানেক দর্শক। ভিড় ঠেলে কোনমতে গ‍্যালারিতে জায়গা পেলাম। দামামা আর বিউগল বাজিয়ে শুরু হলো ম‍্যাচ। হাফটাইমের আগেই দিল্লি একটি গোল দিয়ে দিল। অনিল আঙ্কেল ওয়েট কেন্টিন থেকে সমোসা আর পেপসি নিয়ে এলেন। যাদের সেনাবাহিনীর কেম্পে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে তারা নিশ্চয়ই জানেন কেন্টিনের সমোসা বলতে গেলে দুনিয়ার সেরা। দুটো সমোসা আর সাথে চা বা কোল্ড ড্রিংক খেয়ে নিলে আর ভাত খাওয়ার দরকার পড়ে না। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হলো। দশমিনিটের মাথায় এবার চেন্নাই গোল করল। স্কোর এক - এক। দিল্লির এক খেলোয়াড়কে ফাউল করার জন্য রেফারি হলুদ কার্ড দেখালেন। দারুর প্রতিযোগিতাপূর্ণ ম‍্যাচ। একদল অন‍্যদলকে জোরদার টক্কর দিচ্ছে। কিন্তু শেষমেশ যা হ‌ওয়ার তাই হলো। খেলা শেষ হ‌ওয়ার তিন মিনিট আগে দিল্লি কর্নার কিক পেলো। এক পাঞ্জাবি খেলোয়াড় হেড মেরে দিল্লিকে জিতিয়ে দিলেন। কি হুলস্থুল শুরু হয়ে গেল। পটকার শব্দে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। খেলায় হেরে চেন্নাইর খেলোয়াড়রা কাঁদছিল। দেখে আমার‌ও মন খারাপ হয়ে গেল। এই দুনিয়ায় যাঁরা হেরে যায় তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।
রাত্রে টেগোর হলে সিলেব্রেসন পার্টি ছিল। আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন। অনেক বড় বড় অফিসারের সাথে পরিচয় হলো। আব্বা উনার কমানডিং অফিসার এনি আব্রাহামের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। উনি আব্বাকে বললেন "রহমান তোমহারা বেটা ইতনা বড়া হো গায়া"! ইফেকটিভ টেলিসারভিসে ট্রেনিং চলছে জেনে উনি খুব খুশি হলেন। বললেন সময় পেলে উনার বাংলোয় যেতে। চা খেয়ে আড্ডা দেয়া যাবে। এই প্রথম একজন চল্লিশ বছরের পাশাপাশি বয়সের এক মহিলাকে দেখলাম যিনি একটি পুরো বেটেলিয়ান চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে ২০০০ জন সেনাকর্মী থাকেন। নিঃসন্দেহে উনি শ্রদ্ধার পাত্র। পরবর্তী অংশগুলোয় উনার গল্প‌ও স্থান পাবে। আমার জীবনে এনি আব্রাহামের অবদান অপরিসীম।
দ্বিতীয় সপ্তাহের ট্রেনিং শেষ হলো। অনেক কিছু শেখা হয়ে গেছে। ব‍্যাচ থেকে ইতিমধ্যে দশজনকে বের করে দেয়া হয়ে গেছে। আমি কোনমতে টিকে গেলাম। তৃতীয় সপ্তাহের ট্রেনিং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি কোয়ার্টারে এসে এত প্রেকটিস করতাম যে রাতে ঘুমের ঘোরেও ইংরেজি বলতাম। শেষের দিকে কিছুটা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলাম। আত্মবিশ্বাস ছিল আমি পাশ করে যাবো। এই সপ্তাহের শেষে পরীক্ষা হবে আর এটাই হবে ফাইনাল। যারা ৮০% নম্বর পাবেন কেবল তারাই চাকরি পাবেন। যত দিন এগিয়ে আসছিল ভয় হচ্ছিল, কি জানি কি হয়।


প্রবাসের ডাক: ১৭
আমাদের ট্রেনিংয়ের সেরা সময় ছিল শেষের সপ্তাহ। ইতিমধ্যে উচ্চারণ চর্চা শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্লাসে মুলত গল্পের আসর চলছিল। মিঃ নায়ার উনার অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে প্রান খুলে শেয়ার করতেন। উনার কাহিনী শুনে শুনে আমেরিকার সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ঘটনা প্রবাহ ইত‍্যাদি সম্পর্কে এক স্পষ্ট ধারনা মাথায় ছেপে গিয়েছিল। ওখানকার ভুগোল ইতিহাস ইত‍্যাদি সম্পর্কেও অনেক কিছু জানা গেলো। যদি চাকরি হয় তবে এই সব সম্বল করেই আগামীতে কর্মজীবনের সোপান বেয়ে উপরে উঠে যেতে হবে।
আমরা কয়েকজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে রনজিত, আকাশ, অভিষেক, রিজু, কুনাল আর আমি একসাথেই থাকতাম। কুনাল ছাড়া বাকি সবাই গান্ধী নগরের। ও আসত আহমেদাবাদের চান্দখেড়া থেকে। কলেজ জীবনের অপুর্ণ জীবন যেন এখানকার ট্রেনিংয়ে এসে পুর্নতা পেল। আমরা সবাই এক পরিবারের মত হয়ে গিয়েছিলাম। পরবর্তী জীবনে এমনকি আজ অবধি আমরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পেরেছি।
চল্লিশ জন দিয়ে শুরু হয়েছিল ক্লাস। ইতিমধ্যে দশ জনকে পারফরম্যান্স না থাকায় বের করে দেয়া হয়েছিল। তৃতীয় সপ্তাহের পর মোট পরীক্ষার্থী ৩০ জন। ৪০০ নম্বরের পরীক্ষা হবে। লিখিত আর মৌখিক। সেই প্রথম দিন থেকে যা যা শেখানো হয়েছিল সব আসবে প্রশ্নপত্রে। পরীক্ষা ছিল শনিবার। এর আগের দিন শুক্রবার স্টাডি ব্রেক হিসেবে ছুটি দেয়া হলো। আমি সারাদিন সারারাত চর্চা করলাম। পরীক্ষা হবে দুই শিফটে। প্রথম দুই ঘণ্টা লিখিত পরীক্ষা। এর পর এক ঘন্টা বিরতি। আর শেষের দুইঘন্টা মৌখিক। মৌখিকের মধ্যে একটি রোল প্লে বা‌ মক কল‌ও থাকবে। মক কল মানে - একজন গ্রাহকের অভিনয় করে ফোন করবেন আর আরেকজন কাস্টমার কেয়ার এজেন্ট হিসেবে গ্রাহকের সমস্যার সমাধান করবেন।
সকাল দশটা থেকে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। লিখিত পরীক্ষা মোটামুটি ভালোই হলো। রনজিতের খুব ভালো হয়নি। মাঝখানের এক ঘন্টার বিরতিতে আমরা গেটের বাইরে গিয়ে চা আর ফাফড়া খেলাম। রনজিত খুব টেনসনে ছিল। চাকরির দরকার ওর খুব বেশি।
এরপর মৌখিক পরীক্ষা শুরু হলো। গ্রুপ ডিসকাশন, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, রিডিং টেস্ট আর মক কল দিয়ে শেষ হলো। মিঃ নায়ার ঘোষণা করলেন ছয়টার সময় ফলাফল ঘোষণা করা হবে। তখন‌ও দুই ঘন্টা বাকি ছিল। আমরা পার্কে বসে গল্প করতে লাগলাম। সময় যেন কাটছিল না। আমি‌ খুব বিষন্ন ছিলাম। যদি সিলেক্সন হয় না তবে আর এখানে আসার সুযোগ থাকবে না। হয়ত আবার ইন্টার্ভিউ দেয়া শুরু করতে হবে। প্রায় এক মাস কঠোর পরিশ্রম করা গেছে। দিন রাত প্রেকটিস হয়েছে। এবার যদি ফল পাওয়া যায় না তবে সত্যিই খুব খারাপ লাগবে। হয়তো বাড়ি ফিরে যাব।
সাড়ে পাঁচটায় আমরা সবাই কনফারেন্স হলে উপস্থিত। ঠিক ছয়টার সময় মিঃ নায়ার হলে ঢুকলেন। সবাইকে বসতে বললেন। বললেন, ‌উনি কয়েকজনের নাম ঘোষণা করবেন । তারা যাতে হলের ডানদিকে জমায়েত হয়। বাকিরা বামদিকে জড়ো হয়ে থাকবে। একে একে এগারো জনের নাম ঘোষণা হলো। কিন্তু আমার নাম নেই। রনজিতের‌ও নাম ডাকা হলো না। বুঝতে পারলাম আমাদের কাহিনী এখানেই শেষ। সিলেক্সন হয় নি। আমার পায়ের তলায় মাটি সরে যাচ্ছিল। চোখের কোনায় জল। এরপর মিঃ নায়ার বাম দিকের সবাইকে গুনতে লাগলেন। মোট ঊনিশ জন। মিঃ নায়ার প্রথমে ডাকা এগারো জনকে বললেন যে ওরা ফেল করেছে। ওদের সবাই ষাট শতাংশের কম নম্বর পেয়েছে। তার মানে? আমি চমকে উঠলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তার মানে আমরা ঊনিশ জন ফেল করি নি। মিঃ নায়ার অনুত্তীর্ণ হ‌ওয়া এগারোজন প্রার্থীকে দুই নম্বর হলে গিয়ে বসতে বললেন। এর পর উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন মাত্র একজন পরীক্ষার্থী ৮০% এর বেশি নম্বর পেয়েছে। নাম - শরীফ আহমদ।
এর পর কে কি বলছিল আর মিঃ নায়ার কাকে কি বলছিলেন কিচ্ছু মনে নেই। খুব জোরে বোমা ফাটার পর যে ভাবে মানুষ কিছুক্ষণ কিচ্ছু শুনতে পারে না, বলতে পারে না, এমন হয়ে গিয়েছিলাম। বাকহীন আমি। চোখে জল আর মনে কি প্রশান্তি। জীবনের চিরস্মরণীয় দিন।‌ এত আনন্দ কখনোও হয়নি। আমার সিলেক্সন হয়ে গেলো ফাইনালি।


প্রবাসের ডাক: ১৮
সোমবার থেকে আমাদের নিয়মিত কাজ শুরু হয়ে গেলো। যেহেতু আমেরিকায় দিন হলে আমাদের দেশে রাত হয় অত‌এব নাইট শিফট করতে হবে। প্রথম দিন আমাদের ইনডাকশন হলো। এইচ‌আর বিভাগের কর্মিরা আমাদেরকে নিয়ে মিটিংয়ে বসলেন। সবাইকে এক এক কপি করে এমপ্লয়িজ মেনুয়েল দেয়া হলো। কোম্পানির সব পলিসি এই মেনুয়েলে লেখা আছে। সপ্তাহে ছয়দিন নয় ঘন্টা করে কলিং করতে হবে। পুরো শিফটে দেড় ঘণ্টা বিরতি থাকবে যা রাতের ডিনার আর চা/কফি খাওয়ার জন্য ব‍্যবহার করা যাবে। আমাদেরকে ফুড কার্ড দেয়া হলো। এই ফুড কার্ডে মোট বারোশো টাকার ক্রেডিট জমা থাকবে। এই বেলেন্স থেকে আমরা গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকা হোটেল বা ক‍্যাফে থেকে খাবার চা কফি ইত্যাদি কিনে নিতে পারি। নতুন মাসের শুরুতে আবার ফুড কার্ডের বেলেন্স বারোশো টাকা হয়ে যাবে। আমাদের সবাইকে একটি করে লকার দেয়া হলো। কলিংয়ের জন্য Plantronics কোম্পানির নির্মিত হেডসেট দেয়া হলো। এত ভালো টেলিকলিং হেডসেট অন‍্য কোন কোম্পানি বানাতে পারে বলে আমার জানা নেই।আমাদেরকে জানানো হলো এই হেডসেট যদি হারিয়ে যায় তবে বেতন থেকে পাঁচ হাজার টাকা কেটে ফেলা হবে। তাই রোজ কাজের শেষে হেডসেট লকারে রেখে দিতে হবে। আমাদের তিন মাসের প্রবেশন পিরিয়ড থাকবে। প্রবেশন চলাকালীন ইমারজেন্সি ছাড়া কোন ছুটি নেয়া চলবে না। তিন মাস পর প্রতি মাসে তিন দিন করে ছুটি জমা হবে যা একসাথে বা আলাদা আলাদা ভাবে নেয়া যেতে পারে।‌ বৎসরে মোট সাত দিনের সিক লিভ থাকবে যা প্রয়োজনে নেয়া যেতে পারে। এছাড় প্রতি সপ্তাহে একদিন করে ছুটি থাকবে।
আমাদের বেতন হবে মাসিক ৫৬০০ টাকা। এর উপর পারফরম্যান্স অনুযায়ী বোনাস বা ইনসেনটিভ পাওয়া যাবে। জানলাম ভালো কাজ করলে আরাম সে বিশ ত্রিশ হাজার টাকা কামানো যাবে। আমাদের উনিশ জন কে বিভিন্ন বিভাগে কাজ করতে হবে। আমি, রনজিত সহ আর‌ও কয়েকজনকে বিএস‌আইডি ইনবাউন্ড বিভাগে দেয়া হলো। বিএস‌আইডি মানে বেলসাউথ ইন্টারনেট ডায়েল আপ। বেলসাউথ হলো ইন্টারনেট কোম্পানি।
ইনবাউন্ড মানে আমাদেরকে কাস্টমারদের কল রিসিভ করতে হবে। সংক্ষিপ্তভাবে আমাদের প্রডাক্ট ট্রেইনিং হয়ে গেল। মুলত কোম্পানির বর্তমান গ্রাহক যাদের লেন্ডলাইন ফোন আছে তারাই নতুন ইন্টারনেট কানেকশন নেয়ার জন্য কল করবেন। আমাদেরকে ওদের ফোন নম্বর নিয়ে ভিএন‌এস নামক সফটওয়্যারে একাউন্ট খুলে ইন্টারনেট কানেকশন যোগ করে দিতে হবে। এর পর কোম্পানির ওয়েবসাইটে গিয়ে গ্রাহকদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফর্ম পুরন করে দিতে হবে। কাজ আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও এত সহজ নয়। গ্রাহকরা অনেক প্রশ্ন করতে পারেন।‌ ইন্টারনেটের স্পিড, মাসিক শুল্ক আর অফার ইত‍্যাদি গ্রাহকদেরকে বোঝাতে হবে। গ্রাহক সন্তুষ্ট হলেই কানেকশন নিয়ে নেবে আর সেটা হবে আমাদের জন‍্য একটি সেল। প্রতিমাসে আমাদের টার্গেট থাকবে।‌ টার্গেট পুরো হলেই বেতনের উর্ধ্বে অতিরিক্ত বোনাস দেয়া হবে।
পরের দিন থেকে আমরা প্রোডাকশন ফ্লোরে গেলাম। আমাদের শিফট টাইম বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত আড়াইটা। শিফট শেষ হলে কোম্পানির গাড়ি সবাইকে নিজেদের ঘরে পৌঁছে দেবে। প্রথম দুই তিন দিন আমাদেরকে সিনিয়র কলারদের কল লাইভ শুনতে দেয়া হলো এই পদ্ধতিকে সাইড-জেকিং বলা হয়। সিনিয়র কলারের হেডসেটে আমাদের হেডসেট সংযোগ করে পুরো কথোপকথন চুপচাপ শুনতে হবে। কল শেষ হলে সিনিয়র পুরো কল ডিটেইলস বুঝিয়ে দেবেন। আমাকে রাজা শেখ নামের একজনের সঙ্গে বসিয়ে দেয়া হলো। রাজা ‌শেখ নাম করা কলার ছিল। ও সবার থেকে বেশি সেল করতে পারত আর ইনসেনটিভ‌ও বেশি কামিয়ে নিত। রাজা আমাকে এক একটি কল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝিয়ে দিত। কল চলাকালীন আমি গ্রাহক আর রাজার কথোপকথন বুঝতে পারতাম না। গ্রাহকরা অনেক প্রশ্ন করত যা আমার মাথায় ঢুকত না। কিন্তু রাজা অনর্গল উত্তর দিয়ে যেতে পারত। আমাকেও শীঘ্রই বুঝে নিতে হবে আর রাজার মত উস্তাদ হতে হবে। ন‌ইলে প্রবেশন পিরিয়ডের মধ্যেও বের করে দেয়া হতে পারে। আমি ধীরে ধীরে শিখে নিচ্ছিলাম তবুও ভয় হচ্ছিল। আসল কলিং যখন শুরু হবে তখন বোঝা যাবে কত ধানে কত চাল।
আমার টিম লিডার ছিলেন আমার‌ই বয়সের গোবিন্দ রাজপুত। গত ছয়মাস গোবিন্দ এজেন্ট ছিল। ইদানিং ও টিম লিডার হিসেবে প্রমোশন পেয়েছে। ও মাঝে মাঝে আমাদের খবর নিয়ে যাচ্ছিল। টিম লিডারের কাজ হলো প্রতিটি গ্রুপের পারফরম্যান্সের প্রতি লক্ষ্য রাখা, ট্রেনিং দেয়া আর নিজের গ্রুপের প্রাথমিক সকল সুবিধা অসুবিধার সমাধান করা। গোবিন্দ খুব ভালো একজন টিম লিডার হিসেবে পরিচিত ছিল। আমাদের মাইক্রোব‍্যাচের পাঁচজনকে নিয়ে শিফট শেষ হ‌ওয়ার আগে ও অন্তত এক ঘন্টা আলোচনা করতো। আমরা কি শিখলাম, কোন‌ ডাউট বা কনফিউশন আছে কি না ইত্যাদি আলোচনা হতো।
তিন দিন পর আমাদেরকে লাইভ কল নিতে বলা হলো। সিনিয়র কলাররা আমাদের প্রতিটি কল মনিটার করছিলেন আর আমাদের বোঝার অসুবিধা হলে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের কল নিয়ে নিচ্ছিলেন। সবাই খুব সহযোগী ছিলেন। এই পরিবেশ আমার খুব ভালো লাগছিল। একেই বলে টিম স্পিরিট।
আমি প্রথম দিকে কল সামাল দিতে পারতাম না। রাজা আমাকে খুব সাহায্য করত। কাজের দুনিয়ায় রাজা শেখ‌ই আমার প্রথম গুরু। যখন আমি কিচ্ছু জানতাম না বা বুঝতাম না তখন ওই আমাকে ধীরে ধীরে পারদর্শী বানিয়ে ফেলে। নিঃস্বার্থভাবে ওর করা সাহায্য কোনদিন ভুলতে পারবো না। আমার কর্ম জীবনে ওর অবদান অনস্বীকার্য।


প্রবাসের ডাক: ১৯
শুরুতে কাজ কঠিন মনে হচ্ছিল কিন্তু শীঘ্রই সব কিছু শিখে ফেললাম। আমি যে কেম্পেইনে কাজ করতাম তাতে মোট ষোল সতেরো ‌জন কর্মী ছিলেন। ধীরে ধীরে আমি টপার হয়ে গেলাম। প্রতি মাসে রিওয়ার্ড এন্ড রিকগনিশন সিরোমনি (সংক্ষেপে আর‌এন‌আর) অনুস্ঠান হতো। ঐ দিন প্রত‍্যেক ডিপার্টমেন্টর সেরা সেইলসমেনকে প্রশংসা পত্র দেয়া হতো। সঙ্গে থাকতো বিশেষ খাবারের আয়োজন। দ্বিতীয় মাস থেকেই শুরু করে যতদিন আমি ইফেকটিভ টেলিসারভিসে চাকরি করি প্রতিমাসে টপ পারফরম্যান্স আমার‌ই থাকতো। মোট তিরিশ বার আমি ঐ সার্টিফিকেট পেয়েছিলাম যা আজও সযত্নে রেখে দিয়েছি। বোনাস মিলিয়ে মাসে চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকা কামানো ছিল নিত্ত নৈমিত্তিক। ২০০৫ সাল থেকেই ইনকাম টেক্স আর যাকাত দেয়া চালু করি আর আজ‌ও দিয়ে যাচ্ছি।
কোম্পানির ইতিমধ্যে নতুন নামকরণ হয়ে যায়। ইটেক ইনকরপোরেশন। সংক্ষেপে ইটেক। খুব কম দিনের ভিতরেই ইটেক গুজরাটের সবচেয়ে বড় বিপিও হয়ে যায়। আমাদের মেনেজমেন্ট ছিল আমেরিকার। তাই পরিশ্রমী কর্মীদের জন্য আনন্দ, জ্ঞান আহরণ, প্রমোশন আর টাকার কোন অভাব ছিল না।
কোম্পানির একটি স্কিম ছিল ডায়েলিং ফর ডলার (ডিএফডি)। প্রত‍্যেক সেল (বিক্রি) বা অন‍্যান‍্য প্রশংসা মুলক কাজের জন্য সবাইকে এই কাগুজে ডলার দেয়া হত। টিম পারফরম্যান্স, এটেনডেন্স, লয়েলটি, কম্পিটিশন ইত‍্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শী কর্মীর একাউন্টে জমা হতো ডিএফডি। প্রতি দুইমাসে ডিএফডি স্টোরের আয়োজন করা হত যাতে এই ভার্চুয়াল কারেন্সি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র কেনা যেত। বিদেশি কাপড় চোপড়, জুতো, ঘড়ি, টাই, পারফিউম, বাসনপত্র, ইলেকট্রনিক্স ইত‍্যাদি সব‌ই পাওয়া যেত এই স্টোরে। আমার এত ডিএফডি জমা হতো যে স্টোর থেকে কিনে আনা বস্তু কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি থাকা বন্ধুদের সাহায্য নিতে হতো। ডিএফডি স্টোর থেকে কিনে আনা ডাইনিং সেট, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন এখনও আমাদের ঘরে ব‍্যবহার হচ্ছে।
কেম্পের খাওয়া দাওয়ার আর বিশেষ করে রাতের শিফটে চাকরি থাকায় কিছু অসুবিধা হচ্ছিল। আব্বা পরামর্শ দিলেন যে অফিসের পাশাপাশি কোথাও ভাড়াটে ঘর নিয়ে নিলে ভালো হবে। আব্বার একজন বন্ধু ছিলেন। সিদ্দিকি আঙ্কেল। উনি থাকতেন সেক্টর পাঁচে। উনার পরামর্শেই সেক্টর পাঁচের মসজিদ সংলগ্ন হোস্টেলে চলে এলাম। আব্বা থাকতেন কেম্পে আর আমি হোস্টেলে।‌ ছুটীর দিন চলে যেতাম আব্বার কাছে। সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে আবার চলে আসতাম। রাতের শিফট থাকায় পুরো দিন ঘুমিয়ে কাটাতাম। প্রথম দিকে বিরক্তিকর হলেও পরবর্তীতে শরীর সবকিছু সয়ে নিল আর রুটিন মাফিক হয়ে গেল রাতের কাজ আর দিনের ঘুম।
এরমধ্যে আব্বা একটি মোবাইল ফোন কিনে দিলেন।‌ নোকিয়ার মোবাইল আর হাচ সিম। এই হাচ পরবর্তীতে ভোডাফোন হয়ে যায়। ঐ মোবাইলে সাপ আর বিন্দুর একটি গেইম ছিল। সময় পেলে খুব খেলতাম। স্মার্টফোনের যুগ তখন‌ও আসে নি।
কয়েকদিন পর হঠাৎ একদিন একটি কল এলো। ভাঙ্গা গলায় অপর দিক থেকে আসা কথা প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না। পরক্ষণেই বোঝলাম আব্বা কল করেছেন। উনার গলা ভেঙ্গে গেছে। আগের রাত থেকেই নাকি ওরকম আওয়াজ হয়ে গেছে। অনেক জোর করে বলতে হচ্ছে কিন্তু কন্ঠস্বর স্পষ্ট হচ্ছে না। নিশ্চয়ই ঠান্ডা লেগে এমন হয়েছে। উনি নাকি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। ডাক্তার এক সপ্তাহের অষুধ দেন। এক সপ্তাহ পর আবার যেতে হবে।


প্রবাসের ডাক: ২০
সবকিছু খুব ভালো চলছিল। আমার চাকরি পার্মানেন্ট হয়ে যাওয়ায় আব্বাও বড় আনন্দিত ছিলেন। ডিপার্টমেন্টের সবাইকে ডেকে ডেকে আমার চাকরি আর টপ পারফর্মার হ‌ওয়ার খবর দিচ্ছিলেন। আমিও খুব খুশি ছিলাম। আব্বা আমাকে বললেন উনি স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নেবেন। অনেক দিন থেকেই ভাবছিলেন। আমার চাকরি হয়ে যাওয়ায় উনি শিওর হয়ে গেলেন যে এখন আমি যে কোন ভাবেই হোক নিজের জীবন ধারণ করতে পারব। আমাকে নিয়ে আর উনার কোন চিন্তা নেই। আব্বার অনেক শখ অবসর নিয়ে বাড়িতে থাকবেন, নিয়মিত ভাবে মসজিদে যাবেন আর বাড়ির কচিকাঁচাদেরকে পড়াবেন। আমাকে জানিয়ে দিলেন আমার বেতনের পয়সা যেন আমার কাছে রাখি। ভবিষ্যতে আমার‌ই প্রয়োজন হবে। উনার পেনশনের টাকায় আরামসে পরিবারের খরচ চলে যাবে। আমি কিন্তু মাসের শেষে পাওয়া চেক উনার হাতে দিতাম। তারপর‌ই বেঙ্কে জমা করতাম। আমার মনে আছে প্রথম মাসের বেতন পেয়ে আব্বাকে একটি শার্ট আর একটি পেন্টের কাপড় কিনে দিয়েছিলাম। জীবনের প্রথমবার আব্বাকে এক ক্ষুদ্র উপহার দিতে পেরে খুব আনন্দিত হয়ে ছিলাম। উনিও খুব খুশি হলেন।
কয়েকদিন পর আমি যখন সেক্টর পাঁচে থাকি তখন একদিন আব্বার ফোন আসে। উনার গলার স্বর ভেঙ্গে গিয়েছিল। খুব বেশি কাশি হয়ে ইনফেকশন হয়ে গেলে যেভাবে গলার আওয়াজ বের হয়না তেমনি হয়ে গিয়েছিল। উনি গ্রুপ সেন্টার হাসপাতালে ডাক্তার দেখালেন। ডাক্তার বললেন সাধারণ ব‍্যাপার। ইনফেকশন হতে পারে। ঔষধ দেয়া হলো। এক সপ্তাহের ভেতরে কমে যাবে। সপ্তাহ খানেক পর উনি আংশিক ভালো হলেন। ডাক্তার ওষুধ চালু রাখার পরামর্শ দিলেন।
এরমধ্যে আব্বা বার্ষিক ছুটি যাবেন বলে ঠিক করলেন। দুইমাসের ছুটি নিয়ে ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে বাড়ি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আব্বাকে আমার জমানো টাকা দিয়ে দিলাম। বাড়িতে নিশ্চয়ই কোন কাজে লাগবে। আব্বা প্রথমে নিতে চাইলেন না। বললেন আমার কাছেই থাকুক। টাকার এখন দরকার নেই। আমি জোর করেই দিয়ে দিলাম। ঐ টাকা দিয়ে আব্বা বাড়িতে গিয়ে বাথরুম আর দমকলের কাজ করালেন। দুইমাস পর আব্বা ফিরে এলেন। উনাকে আনতে আহমেদাবাদ রেল স্টেশনে গেলাম।
স্টেশনে আব্বাকে দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। উনি অনেক ক্ষীণ হয়ে গেয়েছেন। তখন‌ও কন্ঠস্বরের অসুবিধা কম হয়নি। আমার চোখে জল এসে গেল। মাত্র দুই মাসে উনার শরীরের এত অবনতি হবে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। শীঘ্রই ভালো চিকিৎসা আরম্ভ করার প্রয়োজন।
পরের দিনই উনাকে নিয়ে আহমেদাবাদের এক ইএনটি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার কয়েকটি টেস্ট করার জন্য বললেন। অভয় দিলেন ভয়ের কোন কারণ নেই। পরের দিন রিপোর্ট আনতে যেতে হবে।



প্রবাসের ডাক: ২১
আব্বার শরীর খুব খারাপ।‌ সঠিক চিকিৎসা না করিয়ে দুমাস ছুটি কাটানোর জন্য বাড়ি যাওয়া ঠিক হয় নি। সেনা বাহিনীতে কাজ করেন। বয়স পঞ্চাশের বেশি হ‌ওয়া সত্ত্বেও রোজ ব‍্যায়াম করতেন। শরীরের গঠন চোখে লাগার মতো ছিল। রোজ সকালে উঠে জামায়াতের সহিত নামাজ আর তেলাওয়াত কখনও মিস করতেন না। অকস্মাৎ কি যে হয়ে গেলো বোঝা যাচ্ছে না। ডাক্তার যদিও বলছে চিন্তা করার কোন কারণ নেই কিন্তু এত শীঘ্র উনার শরীরের ওজন এতখানি কম হয়ে যাওয়া সত‍্যিই চিন্তার ব‍্যাপার। হয়তো সাধারণ ইনফেকশন কিন্তু ভালো করে কথা বলতে পারছিলেন না। প্রায় তিন মাস এন্টিবায়োটিক সহ অনেক ওষুধ খাওয়া হলো কিন্তু কোন ফায়দা হচ্ছে না। বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করানো হলো। রেজাল্ট নরম‍্যাল। শেষমেশ গান্ধী নগর সিভিল হাসপাতালের ডাক্তার মেহতা আহমেদাবাদের এক অনকোলজি বিশেষজ্ঞকে রেফার করলেন।
আহমেদাবাদের গ্লোবাল হাসপাতালে আব্বাকে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার আর‌ও কয়েকটি টেস্ট করার জন্য বললেন। ঐদিন‌ই ব্লাড আর ইউরিন সেম্পুল দেয়া হলো। পরের দিন আমি আব্বা আর উনার দুজন সহকর্মীকে নিয়ে রিপোর্ট আনতে গেলাম। আমাদের কাউন্সেলিং করবেন আহমেদাবাদের নাম করা বিশেষজ্ঞ সার্জন ডাঃ মিশ্রা।
আমার যা সন্দেহ ছিল তাই হলো। ডাক্তার বললেন আব্বার লাংস্ কেনসার। ইতিমধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আব্বা খুব স্বাস্থ্য সচেতন। জীবনে কারুর কোন ক্ষতি করেন নি। বয়স মাত্র তেপ্পান্ন। উনার কেন্সার কেন হবে? আমি ওখানেই উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। ২০০৫ সালে কেন্সার মানেই ধরে নেয়া যায় এর কোন সঠিক চিকিৎসা নেই। আর যখন রোগ তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে তখন আরোগ্যের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আব্বার মুখের দিকে তাকাবার সাহস পাচ্ছিলাম না। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন এসব স্রস্টার ইচ্ছা। আমরা চিকিৎসা করে যাবো। বাকি আমাদের তকদির বলে ধরে নিতে হবে। চিন্তা করে কোন লাভ নেই। যা হবার তাই হবে। আব্বার চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস ছিল দেখার মতো।
ডাক্তার অনেক ওষুধ দিলেন। বলেন‌ গলায় ইনফেকশনের জন্য কয়েকদিনের মধ্যেই খাওয়ার অসুবিধা শুরু হয়ে যেতে পারে। এমন হলে অপারেশন করে পেটে আর্টিফিশিয়াল পাইপ লাগানো হবে। আর গায়ের জোর‌ ফিরে আসলে কিছু দিনের মধ্যেই কেমোথেরাপি চালু করতে হবে। আরোগ‍্যের সুযোগ আছে কিন্তু নিয়মিত চিকিৎসা করে যেতে হবে। বাকি পরম করুণাময়ের ইচ্ছা।
ভাঙ্গা মন আর অসংখ্য চিন্তা নিয়ে বাড়িতে চলে এলাম। নিজেকে সামলানো কঠিন লাগছিল। বারবার চোখের সামনে আম্মা আর ছোট ভাইয়ের চেহারা ভেসে উঠছিল। আকস্মিক এই দুঃসংবাদ কিভাবে ওরা সহ‍্য করবে। কিন্তু জানাতে তো হবেই। পিসিওতে ফোন করলাম। খবর শুনেই বাড়িতে সবাই জমায়েত হয়ে গেছেন। এখান থেকে পরিবারের সবাইর প্রতিক্রিয়া কেবল অনুমান‌ই করতে পারব। আম্মা খুব কাঁদবেন। উনাকে স্বান্তনা দেয়া সহজ হবে না। আমার মা অসমিয়া। সহজ সরল খোদাভীরু মানুষ। চাকরির জন্য আব্বা গোটা জীবন বাইরে কাটিয়ে দিলেন। বেশিদিন সারা পরিবার একসাথে থাকা হয় নি। বছরে মাত্র দু'বার ছুটি পেতেন আব্বা। আমার জন্মের ছয়মাস পর থেকে আমরা গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। আমরা ভাবছিলাম আব্বা রিটায়ার করে পাকাপাকি ভাবে বাড়িতে থাকবেন। আমি না হয় বাইরেই থাকলাম। বাকি সবাই একসাথে থাকার পরিকল্পনা ছিল। এখন কেবল স্রষ্টাই জানেন কখন আব্বা সুস্থ হবেন আর বাড়ি যাবেন।
বিকেলে আমার কাপড় চোপড় নিয়ে আব্বার সাথে থাকার জন্য কোয়ার্টারে চলে এলাম। উনার জন্য সিক লিভ নেয়া হলো। ডিপার্টমেন্ট থেকে দুজন সহকারী এলেন যারা আমাদের সঙ্গে ২৪ ঘন্টা থাকা শুরু করলেন যাতে আব্বার পরিচর্যার কোন কৈফিয়ত না হয়। এক সপ্তাহ অষুধ খাওয়ার পর আবার ডাঃ মিশ্রাকে দেখাতে হবে। শরীরের শক্তি একটু ফিরে এলেই শুরু হবে কেমোথেরাপি। এরমধ্যে গলার অসুবিধা কম হ‌ওয়া দরকার যাতে উনি ভালো করে খেতে পারেন। হা‌ই পাওয়ারের এন্টি বায়োটিক দেয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ অষুধ খাইয়ে খুব একটা লাভ হলো না। চোখের সামনে উনার শরীরের অবনতি হয়ে যাচ্ছিল। শরীরের ওজন আরও কমে গেল। দেহে এখন প্রোটিনের অভাব হলে চলবে না অতএব ডাঃ মিশ্রা অপারেশন করে পেটের পার্শ্বে পাইপ লাগিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিলেন। পরের দিন সার্জারি হলো। আব্বার স্বাধারন ভাবে খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। এখন উনার প্রধান খাদ‍্য শুধুই তরল পদার্থ। বিভিন্ন ফলের সরবত, ডাল, মাছ মাংসের আর ভেজিটেবল স‍্যুপ পাইপ দিয়ে ঢেলে দিতে হয়। রোজ চারবার করে এরকম তরলিকৃত খাদ্য পাইপের মাধ্যমে দিতে হয়। আব্বার পরিচর্যার জন্য আমার অফিস যাওয়া অনিয়মিত হয়ে গেল। উনার সঙ্গে থাকা আর বিশেষ যত্নের খুব প্রয়োজন। আম্মাকে গুজরাটে নিয়ে আসতে হবে ঠিক হলো। ছোটভাই আপাতত একা বাড়িতে থাকবে। ওর মানসিক অবস্থাও এই কদিন খুব খারাপ ছিল। ফোন করে ওকে চোখের জল সামলে মিথ্যা স্বান্তনা দিতাম - আব্বা ঠিক হয়ে যাবেন। ওকে বলতাম সুস্থ হলেই আব্বাকে নিয়ে বাড়ি আসছি। চিন্তা করিসনা, আমাদের জন্য দোয়া করিস।
২০০৬ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি আমার ক্লাসমেট বন্ধু মনসুর আম্মাকে নিয়ে গান্ধী নগরে এলো।‌ স্টেশন থেকে ওদেরকে নিয়ে এলাম। আম্মা আসায় আব্বার পরিচর্যা আরও ভালো ভাবে শুরু হয়ে গেল। আমার‌ও মানসিক জোর বাড়লো। আব্বার শরীরের ওজন সামান‍্য বাড়ায় ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ, গুজরাট কেন্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে আব্বার কেমোথেরাপি আরম্ভ হলো। লাগাতার তিন মাস প্রত‍্যেক সপ্তাহে উনাকে সেলাইনের সাথে কেমোথেরাপির অষুধ দিতে হবে। প্রথম দুই সপ্তাহ সেলাইন দেয়ার পর আব্বা আরও দুর্বল হয়ে গেলেন। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া আর সম্ভব হচ্ছিল না। চেয়ারে বসে ইশারায় নামাজ আদায় করতেন। অষুধের প্রভাবে মাথার চুল পড়া শুরু হয়ে গেল। প্রথম মাসের চিকিৎসা শেষ হ‌ওয়ার পর সামান্য উন্নতি হচ্ছে এমন মনে হলো। গলার ইনফেকশন কম হ‌ওয়ায় স্বাধারন ভাবে একটু আধটু খেতে পারতেন। নরম করে বানানো ডাল, খিচুড়ি ইত‍্যাদি খাওয়া শুরু করলেন।‌ আমার আর আম্মার আনন্দ কে দেখে। মনে আশা জাগল। হয়তো আব্বা ভালো হয়ে যাবেন। শীঘ্রই উনি আগের মতো হয়ে যাবেন। বাড়ির সবাইকে আব্বার আংশিক শারীরিক উন্নতির কথা জানিয়ে দিলাম।


প্রবাসের ডাক : ২২ (শেষ পর্ব)
কেমোথেরাপি চালিয়ে যাবার কয়েকদিন পর আব্বার শরীর সুস্থ হয়ে উঠলো। স্বাভাবিক ভাবে খাওয়া দাওয়া শুরু করলেন। গলার ইনফেকশন কম হয়ে যাওয়া আওয়াজ‌ও স্পষ্ট হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কথা বলতে পারতেন। আমি আর আম্মা খুব খুশি হলাম। মনে আশার সঞ্চার হলো। নিশ্চয়ই আব্বা ভালো হয়ে যাবেন।
পরের সপ্তাহে ডাক্তারের ভিজিট ছিল। অবস্থা দেখে বললেন আপাতত ইনফেকশন ভালোই দেখাচ্ছে কিন্তু কেমোথেরাপি সম্পুর্ন করতে হবে। পুরোপুরিভাবে ভালো হতে হলে এখনও সময়ের প্রয়োজন। দুসপ্তাহ এমন কাটার পর আব্বা আবার আগের মতো হয়ে গেলেন। সাধারণ ভাবে খাওয়া দাওয়া আবার বন্ধ হয়ে গেল। ফের শুরু হলো পাইপ দিয়ে ফলের রস, স‍্যুপ দেয়া। ধীরে ধীরে আবার কথা বলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। বলার চেষ্টা করতেন কিন্তু কস্ট হতো। ইশারায় কাজ চালাতেন। শরীর খুব দুর্বল। স্নান বা বাথরুমে যেতে হলেও ধরে নিয়ে যেতে হতো। কেমোথেরাপি চলছিল কিন্তু উনি সুস্থ হয়ে উঠছিলেন না।
আমার আর আম্মার সময় বড় দূঃখে কাটতো। বেশিরভাগ সময় আম্মার চোখে জল দেখতাম। আমার‌ও কান্না পেত। কিন্তু একে অন্যের সামনে মনের অবস্থা লুকিয়ে রাখতাম। দেখাতাম কিচ্ছু নয়। আম্মাও সেই চেষ্টা করতেন। বাথরুমে বন্দী করে নিজেকে বলতাম ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। সান্তনা দিতাম নিজেকে। প্রায়ই অফিস কামাই হচ্ছিল।
একদিন বিকেল প্রায় চারটের সময় আব্বার খুব জ্বর। ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলে পেরাসিটামল দিলাম। ডাক্তার আধাঘন্টা অপেক্ষা করে দেখতে বললেন। জ্বর না করলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। জ্বর কমলো না। অগত্যা কেম্প থেকে এম্বুলেন্স ডেকে এনে চললাম আহমেদাবাদ হাসপাতালে। সঙ্গে ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন লোক গেলেন। হাসপাতালে এডমিশান নেয়ার সাথে সাথে ডাক্তার ইনজেকশন আর সেলাইন চালু করে দিলেন। চোখের সামনে আব্বা প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন। জ্বর সাঙ্ঘাতিক। আমার কোলে আব্বার মাথা। শ্বাস নিতে কস্ট হচ্ছিল। অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিলেন ডাক্তার। মাঝে মাঝে আব্বা চোখ খুলে আমাকে দেখছিলেন। ছলছল চোখে একটুকরো ফিকে হাঁসি। যেন আমাকেই অভয় দিচ্ছিলেন। প্রতি মুহূর্তে আমার এমন লাগছিল যে আমি পড়ে যাবো, জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো। বড় কস্ট হচ্ছিল। কান্না থামতে চাইছিল না। এর পর‌ও নিজেকে সামলিয়ে নিচ্ছিলাম। রাত প্রায় আটটার সময় আব্বার আবার শ্বাসকষ্ট চালু হলো। আমি চিৎকার করে উঠতেই ডাক্তার নার্স দৌড়ে এলেন। কে যেন আমার কানে কানে বলে দিয়ে গেল আব্বার সময় শেষ হতে চলছে। পরপারের ডাক এসে গেছে আর। আমি জোরে জোরে কলিমা পড়তে লাগলাম। আমার সাথে সাথে আব্বাও বিড়বিড় করছিলেন। ডাক্তার আব্বার বুকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আটটা পনেরোর সময় আব্বার শ্বাস প্রশ্বাস চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। চলে গেলেন। বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। মাটিতে পড়ে গেলাম। পরবর্তী আধঘন্টা খানেক কিচ্ছু মনে নেই। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। শেষ হয়ে গেল সব। আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটি আর নেই। পিতৃহারা হলাম। ২০০৬ সালের ২৪ মার্চ রাত আটটা পনেরোয় আমার বাবা, এক নিরিহ, ঈমানদার, আজীবন সততায় বিশ্বাসী পঞ্চান্ন বছরের সেনা কর্মি আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন। দূঃখে কস্টে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। ঝাপসা চোখে নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছিল। দাঁড়াতে পারছিলাম না।
মোবাইলে কল আসা শুরু হয়ে গেল। আমার সাথে ছিলেন আব্বার সহকারী ধরমপ্রসাধ আঙ্কেল। উনিই কল নিচ্ছিলেন। হাসপাতাল সিআরপিএফের লোকে ভর্তি হয়ে গেল। সবাই আমাকে স্বান্তনা দিচ্ছিলেন। রাত বারোটা নাগাদ আমাকে জীপে উঠিয়ে ধরমপ্রসাদ আঙ্কেল কোয়ার্টারে নিয়ে এলেন। আম্মাকে খবর আগেই দেয়া হয়ে গিয়েছিল। ওনাকে সামলানো কস্ট হচ্ছিল। আমাকে দেখে আর‌ও অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। আম্মাকে ঘিরে রেখেছিলেন মহিলা ব‍্যাটেলিয়ান আর আসপাশের কোয়ার্টারের মহিলারা।
রাত কিভাবে কাটলো লেখা যাবে না। আমার অফিস থেকে ফোন এলো। ম‍্যানেজার বললেন কোন কিছুর দরকার হলে নিঃসঙ্কোচে বলে দিতে। প্রয়োজনীয় সব ব‍্যবস্তা করে দেয়া হবে। কিন্তু দরকার ছিল না। বললেন সব কিছু শেষ হয়ে গেলে যখন‌ই আবার চাকরি করার ইচ্ছে হয় আমি চলে আসতে পারি। আমার জন্য কোম্পানীর দরজা সবসময় খোলা থাকবে। আমার বিভাগের সাত আটজন সহকর্মীও রাত তিনটে নাগাদ কোয়ার্টারে পৌঁছে গেলেন। একটি খামে আমার দুমাসের বেতন আগাম হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে অফিস থেকে।
এদিকে আব্বার শরীরের মরনোত্তর পরীক্ষা আহমেদাবাদ হাসপাতালে চলছে সিআরপিএফের মেডিকেল বিভাগের লোকদের তত্ত্বাবধানে। আমাকে জানানো হলো পরের দিন সকালের প্রথম বিমানে মৃতদেহ গুয়াহাটি পৌঁছে দেয়া হবে। যেহেতু শিলচরের জন্য ডাইরেক্ট ফ্লাইট নেই তাই গুয়াহাটি থেকে সড়কপথে মৃতদেহ পাঠানো হবে করিমগঞ্জের বাড়িতে। বলাবাহুল্য সব কাজ আর ব‍্যবস্তা ডিপার্টমেন্ট থেকেই করা হচ্ছিল।
পরের দিন আমাদেরকে নিয়ে সিআরপিএফের দুটি বাস আর তিনটি জীপ আহমেদাবাদ হাসপাতালে এলো। ওখান থেকে কফিন সংগ্রহ করে সোজা এয়ারপোর্টে চলে গেলাম। আব্বার শরীর সামনে রেখে সবাই সন্মান জানালেন। সেল‍্যুট আর প্রশাসনিক ভাবে ব্লাঙ্ক ফায়ার করে সামরিক সন্মান জানানো হলো। এর পর বড় বড় অফিসাররা আমার আর আম্মার সঙ্গে একে একে দেখা করে শোক প্রকাশ করলেন। সিআরপিএফ পরিবার আজীবন আমাদের সাথে থাকবে বলে কথা দিলেন ডিআইজি আর কামান্ডেন্ট। বিমানে আমাদের সাথে দুজন সেনাকর্মি এলেন। বিমানের জানালা দিয়ে দেখলাম আব্বার সাথীরা অঝোরে কাঁদছেন। আমার চোখের জল যেন শেষ হয়ে আসছিল না। আম্মার‌ও এক‌ই অবস্থা।
গুয়াহাটি এয়ারপোর্টে আগে থেকেই স্থানীয় বাহিনি আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। একটি ট্রাক, একটি বাস আর দুটো জীপের কনভয়ে মৃতদেহ নিয়ে যাত্রা শুরু হলো করিমগঞ্জের উদ্দেশ্যে। প্রায় শেষ রাতে করিমগঞ্জ পৌঁছলাম। মাঝপথে শিলঙ্গের ব‍্যটেলিয়ান আমাদেরকে জবরদস্তি খাবার খাওয়ালেন। করিমগঞ্জের স্টিমার ঘাট থেকে আরেকটি গাড়ি যোগ হলো বার‌ইগ্রামের উদ্দেশ্যে। সকাল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম গ্রামের বাড়িতে। পৌঁছানোর সাথে সাথেই সে কি কান্নার রোল। আমার ছোটভাই আর চাচাতো ভাই বোনদেরকে সামলানো যাচ্ছিল না। আমাদের একমাত্র পিসি বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন।
স্নান আর কাফন পরানোর পর সকাল দশটা নাগাদ আব্বার মৃতদেহকে সিআরপিএফ বাহিনী আরেকবার লাইনে দাঁড়িয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়ে সন্মান জানালেন। এরপর ধর্মীয় ভাবে আব্বার শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো। গোরস্থান থেকে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ লাগছিল। এত ভিড়ের মাঝেও আমি বড় একা।‌ সবকিছু শেষ হয়ে গেছে যেন। কি যে বিষন্ন শুন‍্যতা চারিদিকে। বলা যায় না।‌ লেখা যায় না। মাটির নির্মিত শরীর মাটিতেই রেখে এলাম। এই মানুষটি আর ফিরে আসবে না। কোনদিনই ঐ আওয়াজ শুনা যাবে না। থাকবে কেবল স্মৃতি। যতবার মনে পড়বে ততবারই ভেঙ্গে যাবো আমি।
চোখের সামনে অতীতের এক একটি ঘটনা ফুটে উঠছিল। আব্বার এক একটি কথা, এক একটি উপদেশ। আর এসব শুনা যাবে না। নশ্বর এই পৃথিবীতে আমি বড় একা হয়ে গেলাম।
কত আঘাত, কত‌ই না স্বান্তনা, সব পেলাম।
কিন্তু তুমি চলে গেলে অচেনা দেশের পথে।
তোমার স্বান্তনা দেয়া বাকি থেকে গেলো ।
বাতাস বড় ভারী, অক্সিজেনের অভাব।
বড় বড় শহরের রাস্তায় আমি চলছি,
ঝড়ের হাওয়ায় উড়তে থাকা শুষ্ক পাতার মতো,
কত রাস্তা, কত‌ই না লক্ষ্য,
কিন্তু এমন কোন পথ নেই,
যা পৌঁছে দেয় তোমার কাছে,
আপাতত!
বড় একা হয়ে গেলাম।
(সমাপ্ত)

Comments

Popular posts from this blog

দেশ বিদেশের গল্প

বাঙলা অসমীয়া

সাবরমতি টু মথুরা